লাশের সমুদ্রসম সারির উপর গাজার ‘শান্তি পরিকল্পনা’
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:৩৮:৩৫ অপরাহ্ন
*ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন * নেতানিয়াহুর পরাজয় না ধোকাবাজি*
জালালাবাদ রিপোর্ট : ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ বন্ধে সোমবার এক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়েছে, পরিকল্পনার ২০ দফা প্রস্তাব মেনে নিলে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হতে পারে।
যে পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বলা হচ্ছে গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে, কিন্তু গাজাকে যেভাবে সাজানো বা পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। এই প্রশ্নও উঠেছে, এটা কি নেতানিয়াহুর পরাজয় না ধোকাবাজি।
এই শতাব্দীর সবচেয়ে নজিরবিহীন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে মাত্র ১৭ বর্গমাইলের উপত্যকাটি। এ সংখ্যা ভয়াবহ রকমের বিশাল, কিন্তু এই সংখ্যা কেবলই বোমা হামলা, জায়নবাদী স্নাইপারদের গুলি কিংবা ভবন ধ্বংসের মতো আঘাতে প্রত্যক্ষভাবে নিহত ব্যক্তিদেরই পরিসংখ্যানমাত্র।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজার ওপর চালিয়ে আসা ইসরায়েলি আগ্রাসনের গতকাল ৭২৪তম দিনে এসে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৬৫ হাজার।
কিন্তু অবরুদ্ধ অবস্থায় তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, পঙ্গু ও অঙ্গহানির শিকার, যাঁদের নাড়াচাড়া করা কঠিন, কিংবা যাঁরা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন অথচ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেসব ব্যক্তি; গর্ভেই যেসব শিশু সিজারিয়ান অপারেশন ও অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে, তাদের সবার সংখ্যা হিসাব করলে এই প্রাণহানির পরিমাণ দাঁড়ায় বহুগুণ।
বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট কর্তৃক জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সরাসরি আঘাতের কারণে সরকারি হিসাবে যে মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে মোট প্রাণহানির সংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি হিসাব মতে, প্রতিটি মৃতের বিপরীতে আরও চারজন মারা যাচ্ছেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা অথবা চিকিৎসাহীনতায়। ফলে সরকারি হিসাব মতে, ৬৫ হাজার শহীদের বিপরীতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখের অধিক। এ সংখ্যা চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর দিকের হিসাবে গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-অষ্টমাংশ।
লাশের এই সমুদ্রসম সারি আর লাখ লাখ আহত নিয়ে পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উপত্যকাটি।
এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইকে অনন্তকালের জন্য অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার নেতানিয়াহুর জন্যও এটা একপ্রকারের রাজনৈতিক পরাজয়ই বটে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি গাজাকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছেন।
কিন্তু এ ঘোষণায় একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট। নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক জীবনজুড়েই এর বিরোধিতা করেছেন। ইসরায়েলের জন্যও এ যুদ্ধ ছিল ব্যাপক ব্যয়বহুল এবং বহুলাংশেই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে পারেননি। যদিও তাঁকে পাশে রেখে এ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। এমনকি কাতারে হামলার জন্য দেশটির আমিরের কাছে ফোন করে ক্ষমাও চাইতে হয়েছে তাঁকে।
কিন্তু নেতানিয়াহু আসলেই এ প্রস্তাবে বিশ্বাস করেন কি না, তা সন্দেহজনক। আন্তর্জাতিক রীতি ও আইনকে উপেক্ষা করার দীর্ঘ প্রতারণামূলক ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের। এই চুক্তি বাস্তবায়নে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের প্রশ্ন আছে। টেকনোক্র্যাট সেই শাসন বোর্ড ও টনি ব্লেয়ারের ভূমিকাও নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।
ট্রাম্প ইতিমধ্যে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, এ প্রস্তাব হামাস মেনে না নিলে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার যে ইসরায়েলি পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করবেন। অথচ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এই পৃথিবীতে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কারোর বিচারের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই; বরং ঔপনিবেশিকতা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাই সুস্পষ্ট। ফলে শেষ পর্যন্ত এ ঘোষণা ফিলিস্তিনে স্বস্তি ও শান্তি আনতে কতখানি ভূমিকা রাখবে, তা এখনই সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন।
হোয়াইট হাউস বলছে, যদি উভয় পক্ষ (ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস) প্রস্তাব মেনে নেয়, তবে যুদ্ধ মুহূর্তেই থেমে যাবে। গাজায় আটক সব জীবিত ও মৃত জিম্মিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আর ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে। নতুন ব্যবস্থায় গাজা শাসনের দায়িত্ব নেবে একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট সরকার। সেখানে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ইসরায়েলও গাজা দখল বা একে তার সঙ্গে যুক্ত করবে না।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন। তবে আল-জাজিরাকে হামাসের কর্মকর্তা মাহমুদ মারদাভি বলেছেন, তাঁরা এখনো গাজার জন্য কোনো লিখিত শান্তি পরিকল্পনা পাননি।
২০ দফা পরিকল্পনা :
১. গাজাকে সন্ত্রাসমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করা হবে, যাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি কোনো হুমকি না থাকে।
২. গাজাকে পুনর্গঠন করা হবে, যাতে বহু কষ্ট সহ্য করা গাজার জনগণ উপকৃত হন।
৩. উভয় পক্ষ প্রস্তাবে রাজি হলে যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হবে। ইসরায়েলি বাহিনী জিম্মি মুক্তির প্রস্তুতির জন্য নির্ধারিত সীমারেখায় সরে যাবে। এ সময় সব সামরিক অভিযান-বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ বন্ধ থাকবে।
৪. ইসরায়েল প্রকাশ্যে এই চুক্তি মেনে নেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
৫. সব জিম্মি ফেরত আসার পর ইসরায়েল যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে। এর সঙ্গে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর আটক করা ১ হাজার ৭০০ গাজাবাসীকেও মুক্তি দেবে। এতে ওই সময় আটক সব নারী ও শিশুও থাকবে। প্রত্যেক ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহের বিনিময়ে ইসরায়েল ১৫ জন গাজাবাসীর মরদেহ ফিরিয়ে দেবে।
৬. সব জিম্মি ফেরত আসার পর, হামাসের যেসব সদস্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মেনে অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হবেন, তাঁদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। হামাসের যেসব সদস্য গাজা ছাড়তে চান, তাঁদের নিরাপদে অন্য দেশে যেতে দেওয়া হবে।
৭. চুক্তি মেনে নেওয়ার পরই গাজায় পুরোপুরি মানবিক সহায়তা প্রবেশ করবে। এতে অবকাঠামো (পানি, বিদ্যুৎ, নর্দমা ব্যবস্থা), হাসপাতাল, বেকারি মেরামত এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে রাস্তা খোলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
৮. জাতিসংঘ ও এর সংস্থাগুলো, রেড ক্রিসেন্ট এবং অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা কোনো পক্ষের সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা গাজায় সহায়তা সরবরাহ ও বিতরণ করবে।
৯. গাজার প্রশাসন সাময়িকভাবে একটি ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট কমিটির হাতে থাকবে। রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এ কমিটি গাজার মানুষের জন্য দৈনন্দিন সেবা পরিচালনা করবে। কমিটিতে যোগ্য ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ থাকবেন। তাঁদের তত্ত্বাবধান করবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংস্থা-‘বোর্ড অব পিস’; যার প্রধান থাকবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংস্থার সদস্য হিসেবে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারসহ অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে।
১০. অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সফল আধুনিক শহরের পরিকল্পনায় কাজ করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গাজা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
১১. গাজায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে শুল্ক ও প্রবেশাধিকারের বিষয়ে আলোচনা হবে।
১২. কাউকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হবে না। যাঁরা যেতে চাইবেন, যেতে পারবেন এবং ইচ্ছা করলে ফিরে আসতেও পারবেন। তবে মানুষকে গাজায় থাকতে উৎসাহ দেওয়া হবে; যাতে তাঁরা নতুন গাজা গড়ে তুলতে পারেন।
১৩. হামাস ও অন্যান্য সংগঠন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বা অন্য কোনোভাবে গাজার প্রশাসনে অংশ নেবে না। সব সামরিক অবকাঠামো-টানেল, অস্ত্র কারখানা ধ্বংস করা হবে এবং পুনর্নির্মাণের অনুমতি থাকবে না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নিরস্ত্রীকরণ করা হবে। অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করে সরিয়ে ফেলা হবে।
১৪. আঞ্চলিক অংশীদাররা নিশ্চয়তা দেবে যে, হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি মানবে এবং নতুন গাজা প্রতিবেশী দেশ বা নিজের জনগণের জন্য হুমকি হবে না।
১৫. আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র গাজার জন্য একটি অস্থায়ী বাহিনী ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ)’ গঠন করবে। এটি দ্রুত গাজায় মোতায়েন হবে। ১৬. ইসরায়েল গাজা দখল বা সংযুক্ত করবে না। আইএসএফ স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করলে ইসরায়েলি সেনারা ধাপে ধাপে গাজা ছাড়বে।
১৭. যদি হামাস এ পরিকল্পনা মানতে দেরি করে বা মেনে না নেয়, তবুও ইসরায়েল যে জায়গা ছাড়বে (যেগুলো ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ করা হয়েছে) সেই জায়গাগুলো আইএসএফের হাতে তুলে দেবে এবং ওই নিরাপদ এলাকায় সাহায্য ও পুনর্গঠনের কাজ চালু হবে।
১৮. গাজায় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে একটি আন্তধর্মীয় সংলাপ চালু হবে। এর লক্ষ্য হবে, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্ণনা বদলানো; যাতে তারা শান্তির সুফল বুঝতে পারেন।
১৯. গাজা পুনর্গঠনের কাজ চলাকালে ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কারপ্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে, ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনে একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এটাই ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্খা।
২০. যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংলাপ শুরু করবে; যাতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সহাবস্থানের জন্য একটি রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় তারা একমত হতে পারে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কতটুকু :
সোমবার ট্রাম্প বলেন, ‘কয়েকটি মিত্রদেশ “বোকার মতো’ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে-তারা সত্যিই এটা করেছে। কারণ, আমি মনে করি যা ঘটছে, তাতে তারা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সুতরাং গাজার উন্নয়ন এবং পিএর ‘সংস্কার’-কে শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি তারপরও একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের আলোচনা শুরু ‘হতে পারে’। এটি নিশ্চিত নয়। ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কী হবে, সেটাও প্রস্তাবে অস্পষ্ট রয়ে গেছে।