থেমে গেলো এক মানবিক-সাহসী যাত্রা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮:৪৫:১৩ অপরাহ্ন
শেষ জাহাজ ‘ম্যারিনেটে’ও আক্রমণ ইসরায়েলের
জালালাবাদ রিপোর্ট : থেমে গেলো গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। এর মাধ্যমে থেমে গেলো এক মানবিক-সাহসী যাত্রা। নৌবহরের সবশেষ জাহাজটিও আটক করেছে আগ্রাসী ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা উপকূলে আসলে ম্যারিনেট নামের জাহাজটির দখল নেয় ইসরায়েলি সৈন্যরা। এর আগে নৌবহরের অন্য সব জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। বহর আটকের পর সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গসহ শত শত কর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। বহরে প্রায় ৪০টি জাহাজ ছিল। লাইভস্ট্রিম ভিডিওতে দেখা গেছে, শুক্রবার সকালে ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা জোর করে সর্বশেষ জাহাজটিতে উঠে পড়ে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় (জিএসএফ) যারা ছিলেন তাদের একটি ইসরায়েলি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং সেখান থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরানো হবে।প্রথম নৌকাটিকে গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামানো হয়, অন্যগুলোকে আরও কাছাকাছি জায়গায় আটকানো হয়। ইসরায়েল সে এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছে, যদিও সেখানে তাদের এখতিয়ার নেই। জিএসএফ এটিকে ‘অবৈধ’ বলে উল্লেখ করছে।
দলটির দাবি, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ “প্রতিরক্ষামূলক নয়, বরং মরিয়া হয়ে নেওয়া আগ্রাসী পদক্ষেপ। তাদের হিসেবে, মোট ৪৪৩ জনকে আটক করা হয়েছে এবং অভিযোগ করা হয়েছে যে অনেকের ওপর জলকামান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। তবে ইসরায়েলের দাবি, সবাই “নিরাপদ ও সুস্থ” আছেন। গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভাঙা এবং গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে প্রায় ৪৫টি জাহাজে করে গাজার দিকে রওনা দিয়েছিলেন ৫০০ অধিকারকর্মী।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রিফিউজি বিরিয়ানি অ্যান্ড বানানাস–এর প্রতিষ্ঠাতা রুহি লরেন আখতার ছিলেন এ অভিযানের অন্যতম যাত্রী। তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানান, তাদের নৌযানটি শেষ পর্যন্ত সাইপ্রাসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, জাহাজে থাকা কয়েকজন যাত্রী “উচ্চ ঝুঁকিতে” ছিলেন এবং আটক হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। রুহি বলেন-আমরা চাই আমাদের সহযাত্রীরা যারা ইতোমধ্যেই আটক হয়েছেন তাদের জন্য সোচ্চার হতে, আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি করতে এবং গাজামুখী নৌযানগুলোর জন্য নিরাপদ করিডর নিশ্চিত করতে।
ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র কাছ থেকে আলাদা অবস্থানে আছেন বলে জানিয়েছেন দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। শুক্রবার দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেছেন। জাহাজ আটক হওয়ার আগে গাজামুখী নৌযান থেকে দেওয়া ভিডিও বার্তায় শহিদুল আলম বলেন, ‘আজ ৩ অক্টোবর ২০২৫। দেখতেই পাচ্ছেন, ঝকঝকা রোদ। আজ আমরা ফিলিস্তিন টাইম জোনে এসেছি। সুমুদ ফ্লোটিলায় যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা ভিন্নভাবে গিয়েছিলেন। আমরা আলাদাভাবে যাচ্ছি।
গাজায় ত্রাণ বহনকারী নৌবহরে হামলার ঘটনায় বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে অনেক দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক ইসরায়েলকে দ্রুত গাজার অবরোধ তুলে নিতে এবং সব সম্ভাব্য সব উপায়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণের প্রবেশাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে যে “আমরা আশা করি পরিস্থিতি নিরাপদভাবে সমাধান হবে”।
আইরিশ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস এই প্রতিবেদনগুলোকে “উদ্বেগজনক” বলেছেন এবং জানিয়েছেন, তিনি আশা করেন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলবে।অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ‘অবৈধ’ এবং “বহু দশক ধরে ইসরায়েল যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়মুক্তি পাচ্ছে তার শেষ হতে হবে।
সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে শত শত মানুষকে আটকের ঘটনার পর প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ফিলিস্তিনিপন্থি বিক্ষোভকারীরা পথে নেমে আসেন। নিন্দা জানাতে ডাবলিন, প্যারিস, বার্লিন এবং জেনেভার রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সমবেত হন। বুয়েনস আইরেস, মেক্সিকো সিটি এবং করাচিতেও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইতালির ইউনিয়নগুলো শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এবং দেশটিতে ১০০রও বেশি মিছিল বা গণসমাবেশের সম্ভাবনা রয়েছে।
শেষ জাহাজ ‘ম্যারিনেট’ :
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, গাজার অবরোধের এলাকায় ঢোকার আগেই ফ্লোটিলার জাহাজগুলো আটকানো হয়েছে। তবে ম্যারিনেট নামে একটি জাহাজ কিছুটা দূরে ছিল যেটি এগিয়ে যাচ্ছিল। এতে ছয়জন যাত্রী ছিলেন। তবে ত্রাণবহরের সেই শেষ নৌযানটিও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আটক করেছে জানাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ট্র্যাকিং-এ এর আগে দেখা যাচ্ছিল এটি আন্তর্জাতিক পানিসীমায় গাজার উপকূল থেকে অনেকটা দূরে। ফ্লোটিলা আয়োজকরা বলছিলেন ম্যারিনেট নৌযানটি “এখনো শক্তিশালীভাবে চলছে”।ম্যারিনেটে থাকা ওমানি কর্মী আমামা আল লাওয়াতি বিবিসি অ্যারাবিককে বলেছিন যে তার নৌকা শুক্রবার দুপুরে গাজা উপকূলে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।তবে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে গাজা থেকে প্রায় ৪২.৫ নটিক্যাল মাইল (৭৯ কিলোমিটার) দূরে ম্যারিনেট নামের জাহাজটিকে আটক করা হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও জানিয়েছে যে নৌবাহিনী ফ্লোটিলার শেষ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, আরোহীদের আটক করেছে এবং জাহাজটিকে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আরও প্রচেষ্টা হবে :
জিএসএফ এর সাথে কাজ করা আইনি দলের একজন সদস্য বলেছেন, ‘আগামী দিনে’ অবরোধ ভাঙার আরও প্রচেষ্টা হবে। জিএসএফ-এর আইনি সহায়তা প্রদান ও পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করা কাইভা বাটারলি (যিনি একটি জাহাজে ছিলেন) বলেছেন, আশা করা হচ্ছে এটি সর্বোচ্চ ১৩টি নৌযান, জাহাজ ও নৌকা হতে পারে এবং এটি গাজায় পৌঁছানোর জন্য একই পথ অনুসরণ করবে।
এটি আয়োজন করবে আলাদা একটি দল, ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, যারা আগের দুটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু দুটোই আটক হয়েছিল। ইতালিতে বুধবার সন্ধ্যায় কিছু শহরে স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ হয়। প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন সিজিআইএল শুক্রবার একটি সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়, যা গাজার সঙ্গে সংহতি জানাতে এবং ইতালির সরকার “আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইতালীয় শ্রমিকদের পরিত্যাগ করেছে”- এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে। ফ্লোটিলা এক মাস আগে স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে, যেখানে ৪০টিরও বেশি নৌযান এবং প্রায় ৫০০ মানুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য, আইনজীবী ও কর্মী ছিলেন। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সরাসরি গাজায় সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।