সিলেটে সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া নৈরাজ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ৫:৫০:১৪ অপরাহ্ন
ভাড়া নির্ধারণে পুলিশ কমিশনারের উদ্যোগ

এমজেএইচ জামিল : আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটে বড় গণপরিবহনের অভাবে ছোট যানবাহনই চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। এরমধ্যে সিএনজি অটোরিক্সাতেই ভরসা সাধারণ যাত্রীদের। কিন্তু চালকদের ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে অতিষ্ঠ যাত্রী সাধারণ। ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে সরকারী কোন দফতরে জবাবদিহীতা না থাকায় তাদের ভাড়া নৈরাজ্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা।
দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা এই নৈরাজ্যে এবার আশার আলো দেখাচ্ছেন নবাগত সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী। চলতি মাসেই নগরীর সকল রুটে সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যদিও এর বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। নগরবাসীর প্রত্যাশা প্রশাসন চাইলে এটি সম্ভব।
যদিও এসএমপির ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে নাখোশ সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের বিভিন্ন সংগঠন। এর ফলে আরো নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা চালকদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালে করোনাকালে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় ৩ যাত্রী বহনের নির্দেশনা দেয় সরকার। তখন ৫ জন যাত্রীর ভাড়া ৩ জনের কাছ থেকে আদায় করা হয়। এরপর করোনা চলে গেলে ২০২১ ট্রাফিক আইনের অজুহাতে ফের ৩ জন যাত্রী বহনের কথা বলে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এখানেও আইন মানেন নি চালকগণ। ফলে ৫ জন যাত্রী বহনের পাশাপাশি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় শুরু হয়। ২০২২ সালে মাঝে মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রীবহনের জন্য ট্রাফিক পুলিশের অভিযানে মামলা জরিমানা আদায় হলেও বর্তমানে অন্যান্য কারণে মামলা হলেও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের ব্যাপারে তেমন দৃষ্টি নেই ট্রাফিক পুলিশের। ফলে অতিরিক্ত যাত্রী থাকার পরও অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের।
এদিকে, নগরীতে চালু থাকা ‘সিটি এক্সপ্রেস’ নামের টাউন বাসের সংখ্যা কম থাকায় সিএনজি অটোরিক্সার ভাড়া নৈরাজ্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে যাত্রীদের। ভাড়া নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশের নিস্ক্রিয়তার কারণে দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে অটোরিক্সা চালক। কেউ ভাড়া নিয়ে প্রতিবাদ করলে চালকদের তোপের মূখে পড়তে হয়। মাঝে মাঝে চালকরা মিলে যাত্রীর গায়ে হাত তোলার ঘটনাও ঘটছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে যে কোন সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনার আশঙ্কা করছেন নিরীহ যাত্রী সাধারণ।
জানা গেছে, বিআরটিএ ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নিরবতার কারণে সিএনজি অটোরিক্সা চালকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সিলেটের হাজার হাজার যাত্রী সাধারণ। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বার্থ বিবেচনায় ২০২৩ সালে সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনসহ সিলেটের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে বসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তৎকালিন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। যদিও সেই উদ্যোগ আলোর মূখ দেখেনি। ভাড়া নিয়ে কিছু করার নেই বলে সবসময় দায় এড়িয়ে গেছে বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ। শুধু অতিরিক্ত যাত্রী বহনে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের আগষ্ট মাস থেকে নগরীতে সিএনজি অটোরিক্সায় গ্রিল লাগানো ও ৩ জন যাত্রী বহনের নির্দেশনা দিয়ে তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। সেই বছরের নভেম্বরে ট্রাফিক পুলিশ কিছুটা হার্ডলাইনে গেলে প্রতিবাদে লাগাতার ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচী পালন করে সিএনজি চালকগন। তাদের প্রতিবাদের মূখে কিছুটা পিছু হটে বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায়, ২০০০ সালে সর্বপ্রথম সিলেট বিআরটিএ কার্যালয়ে থ্রিহুইলার রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সর্বশেষ অটোরিক্সার রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় সিলেট বিআরটিএ-তে। ১৪ বছরে সিলেট বিআরটিএ কার্যালয় থেকে ২১ হাজারের বেশী অটোরিক্সার রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। এর মধ্যে ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ইতোমধ্যে ১৫ হাজার অটোরিক্সা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছে। আইন অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিক্সা চলাচল সম্পূর্ণ বেআইনী। কিন্তু এসব মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিক্সা অবাধে চলছে নগরীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায়।
সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, মদীনা মার্কেট থেকে ওসমানী মেডিকেলের ভাড়া ছিল ৫ টাকা। সেখানে এখন নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা। ভাড়া আদায় করছে মাথাপিছু ১০ টাকা করে। এমন অবস্থা বন্দরবাজার, আম্বরখানা, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, মেজরটিলা, কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড, কদমতলী টার্মিনাল ও মেডিকেল রোডসহ নগরীর সকল পয়েন্টে।
জানা গেছে, বন্দরবাজার থেকে টুকেরবাজারের ভাড়া পূর্বে ছিল ১৫ টাকা। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই ভাড়া ২০ টাকা নির্ধারণ করেন সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড ম্যানেজাররা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে কোন আলাপ আলোচনা না করে নিজেরাই এই ভাড়া নির্ধারণ করেন। এই ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে সে বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারী রাতে বাকবিতন্ডার জের ধরে বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্টে সিএনজি চালকের হাতে খুন হন অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদ। যা নিয়ে গোটা সিলেটে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
এদিকে, বন্দরবাজার থেকে টুকেরবাজারের পুর্বনির্ধারিত ভাড়া ছিল ২০ টাকা। ৩ যাত্রী বহনের কথা বলে জনপ্রতি নেয়া শুরু হয় ৩৫ টাকা। ৫ জন যাত্রী নিয়ে যেখানে পাওয়া যেতো ১০০ টাকা, সেখানে ৩ জন যাত্রী নিয়ে চালক পান ১০৫ টাকা। এতেও সন্তুষ্ট হয়নি অটোরিক্সা চালকেরা। তারা ৫ জন যাত্রী নিয়ে আদায় করছেন জনপ্রতি ৩৫ টাকা।
আম্বরখানা থেকে টুকেরবাজার পূর্বের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। ২০২২ সালে ৩ জন যাত্রীর জন্য জনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ হলেও ৫ জন যাত্রী বহন করেও তখন থেকেই ৩০ টাকা ভাড়া আদায় চলছে।
এমন দৃশ্য বন্দরবাজার টু বটেশ্বর, বন্দরবাজার টু দক্ষিণ সুরমা, আম্বরখানা টু বিমানবন্দর, আম্বরখানা টু টিলাগড়, জেলরোড টু শাহী ঈদগাহ সহ নগরীর সকল রুটে। বন্দরবাজার-শিবগঞ্জ ভাড়া ১০ টাকা হলেও ২০২২ সালে করা হয় ২০ টাকা। বন্দরবাজার-শাহপরান ২০ টাকা হলেও নির্ধারণ হয় ৩৫ টাকা। বন্দরবাজার-ঈদগাহ ভাড়া হলো ১০ টাকা, এই ছোট্ট পথেও ভাড়া দিগুণ করে নির্ধারণ হয়ে ২০ টাকা। এসব ভাড়া নির্ধারণ হয়েছিন ৩ জন যাত্রী পরিবহন বিবেচনায়। কিন্তু সেই থেকে ৫ জন যাত্রী বহন করেও চালকগণ সেই ভাড়াই আদায় করে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত ভাড়ার প্রতিবাদ করলেই নামিয়ে দেয়া হয় গাড়ী থেকে। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই চলছেন সবাই।
এদিকে, আম্বরখানা থেকে এয়ারপোর্টের ভিতর পর্যন্ত পূর্বের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। ২০২২ সালে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা। সবচেয়ে বিস্ময়কর ভাড়া নির্ধারণ হচ্ছে আম্বরখানা-টিলাগড় রুটে। এখানে আম্বরখানা থেকে টিলাগড় যেতে গুণতে হয় ২০ টাকা আবার টিলাগড় থেকে আম্বরখানা ফিরতে লাগে জনপ্রতি ১৫ টাকা। দুরত্ব সমান থাকলেও চালকদের মন মর্জি মতো আদায় হচ্ছে ভাড়া। সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। তাদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করলেও তারাও কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা একটা সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিবহন শ্রমিক নেতা।
সিলেট জেলা সিএনজি অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নগরে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে এসএমপি কমিশনারের আহ্বানে আমরা সাড়া দিয়ে মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছি। আমরা বর্তমানে চলমান ভাড়ার তালিকা জমা দেয়ার জন্য নগরীর সকল সিএনজি স্ট্যান্ড দায়িত্বশীলদের চিঠি দিয়েছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদেরকে ভাড়ার তালিকা প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছি। সেটি হাতে পেলে আমরা এসএমপি কমিশনার মহোদয়ের সাথে দেখা করবো।
তিনি আরো বলেন, সিলেট শহর ও বর্তমান বাজারের তুলনায় বর্তমান ভাড়া খুব বেশী নয়। কারণ একটি সিএনজি দৈনিক সর্বোচ্চ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা আয় করে। এরমধ্যে মালিক ইনকাম ৬০০ ও জ¦ালানী ৪০০ টাকা। তার নিজের পকেট খরচ ২০০ টাকা। সবমিলিয়ে একজন চালক দৈনিক ৫০০ টাকা নিয়ে বাসায় যেতে পারে কিনা সন্দেহ। এরপরও নগরীতে কিছু ক্ষেত্রে ভাড়া নিয়ে অনিয়মের খবর আমাদের কাছেও আছে। আমরাও চাই এসব সমস্যা সমাধান হোক।
বিআরটিএ সিলেট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিএনজি অটোরিক্সার ভাড়া নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ সিএনজি প্রাইভেট গাড়ী তাদেরকে মিটারে চলতে হবে। সিলেটের ক্ষেত্রে চুক্তিতে চলাচল করছে। সেখানে বিআরটিএ কিংবা কোন সরকারী সংস্থা ভাড়া নির্ধারণ করতে পারেনা। তবে আমি শুনেছি এসএমপি কমিশনার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। চালক ও তাদের সংগঠনের নেতাদেরকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে একটি ভাড়া নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। উদ্যোগটি ভালো, লক্ষ্যও ভালো। তবে এখানে সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের দায় নেই।
এ ব্যাপার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিএনজি চালিত অটোরিক্সার ভাড়া নির্ধারণের এখতিয়ার কার্যত আমাদের নেই। আর সিএনজি মূলত প্রাইভেট সার্ভিসের গাড়ী। যেহেতু তারা পাবলিক সার্ভিস দিচ্ছে তাই তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় থেকে চলতে হবে। এই দায় পুলিশের রয়েছে। আর সেই দায় থেকেই আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা সিএনজি চালিত অটোরিক্সার মালিক, চালক ও পরিবহন সংগঠনের নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছি। সেই বৈঠকে তাদেরকে বর্তমান ভাড়ার চিত্র দেয়ার জন্য বলেছি। তারা ১৫ দিন সময় নিয়েছেন। তাদের তালিকা পেলে আমরা আবার তাদেরকে এবং যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসবো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে একটা ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। আমার প্রত্যাশা এই ভাড়া নির্ধারণের পর ভাড়া জনিত নৈরাজ্য দুর হবে।





