এডিস মশার ঘনত্ব উদ্বেগজনক মাত্রায়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ৯:২৭:০২ অপরাহ্ন
এ বছর আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৫০ হাজার

জালালাবাদ রিপোর্ট: স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর নিষ্ক্রিয়তা, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া, এডিস মশার ঘনত্ব উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বছর দেশের এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে গতকাল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল আটটা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ২১৫। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৭৮২ জন নতুন রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হলো ৫০ হাজার ৬৮৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার ৬৮৯ জন। এর আগে আগস্টে আক্রান্ত হন ১০ হাজার ৪৯৬ জন এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু (১০২ জন) হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। বিভাগ ও জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা জেলায় মারা গেছেন ৬৭ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৪৬ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ৪৮ জন। বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলায় যথাক্রমে ৬৩, ৩৭ ও ১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ৬ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৪৯ হাজার ৯০৭ জন এবং মারা গেছেন ২১২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫২.২ শতাংশ এবং নারী ৪৭.৮ শতাংশ। চলতি বছর বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৩,৬৯১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছে সিলেট বিভাগে-মাত্র ১৪৫ জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘গত মাসগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেপ্টেম্বর মাসে তা খারাপের দিকে গেছে এবং অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, টানা ছুটি থাকার কারণে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া, এবং স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোর নিষ্ক্রিয়তা-এসব কারণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
ড. বাশার জানান, জরিপে দেখা গেছে রাজধানীর অনেক এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে বহুতল ভবনের বেজমেন্টে জমে থাকা পানি, ঢাকার পুরোনো বাড়ির আঙিনা বা ছাদের টিনে জমে থাকা পানি, এবং নির্মাণাধীন ভবনের জলাবদ্ধ জায়গায় প্রচুর এডিস মশা পাওয়া গেছে। পানি সংকটের কারণে অনেক এলাকায় মানুষ ড্রাম বা ট্যাংকে পানি জমিয়ে রাখছে, সেখানেও এডিস মশার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু এলাকায় মানুষ সচেতন হওয়ায় নির্মাণাধীন ভবনে মশার ঘনত্ব কিছুটা কমেছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ডেঙ্গু ধীরে ধীরে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং এক পর্যায়ে এটি সারা দেশে একটি এন্ডেমিক রোগে (ঊহফবসরপ উরংবধংব) পরিণত হতে পারে। তাই এখনই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।
ড. বাশার বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা ডেঙ্গু চিকিৎসায় অভিজ্ঞ, তবে কিছু বাস্তব সমস্যা রয়ে গেছে। অনেক সময় একজন রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে সেখানে উপযুক্ত চিকিৎসা না দিয়ে তাকে জেলা হাসপাতালে, সেখান থেকে আবার ঢাকায় রেফার করা হয়। এই রেফার প্রক্রিয়ায় রোগীর প্লাজমা লিকেজ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এতে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে রোগী ট্রান্সফার কমাতে হবে, কারণ এতে ঢাকায় রোগীর চাপ বেড়ে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হটস্পট ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে ড. বাশার বলেন, আক্রান্ত রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে তার বাড়ি ও আশপাশের এলাকায় মশা ধ্বংসে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিতভাবে লার্ভিসাইডি ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংসের ব্যবস্থাও নিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমাজের মানুষকে সচেতন করা। প্রতিটি পরিবারকে নিজের বাসা-বাড়িতে পানি জমতে না দেওয়া, টব, ড্রাম বা পুরোনো পাত্রে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া এবং সপ্তাহে অন্তত একদিন বাসা পরিষ্কার রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এটি সোর্স রিডাকশন বা উৎস নির্মূলের মূল কৌশল,’ যোগ করেন তিনি।







