গণভোটে একমত, বাস্তবায়নে দ্বিমত
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১০:২৮ অপরাহ্ন
আজ সুপারিশ জমা দিবে ঐকমত্য কমিশন
জালালাবাদ রিপোর্ট: নির্বাচন কমিশন যখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে, তখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনের মতামত পেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গণভোটে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে রাজি রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গণভোটের সময় নিয়ে মতভেদ কাটছেনা। এ অবস্থায় আজ শুক্রবারের মধ্যে জুলাই সনদ ও গণভোট বাস্তবায়নে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে ঐকমত্য কমিশন।
তবে বিএনপি চায় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক। নির্বাচনের দিনে গণভোটের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আলাদা করে গণভোট আয়োজন করা ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও প্রশাসনিকভাবে জটিল হবে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে জনগণ একাধিক ব্যালটে ভোট দিতে পারবে, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়।
কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আগামী মাসেই গণভোট চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থাৎ নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের পক্ষে তাঁদের অবস্থান। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর স্ট্যান্ডিং পরিষ্কার-ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে এবং নভেম্বরের ভেতরেই জুলাই চার্টারের ওপরে আমাদের গণভোট হবে। দেশ অত্যন্ত স্থিরতা, দৃঢ়তা, স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে ৫৪ বছরের ভেতরে সবচেয়ে বেশি জন-অংশগ্রহণমূলক আনন্দ-উৎসবের নির্বাচনে যাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে। পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, এনসিপি সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের মাধ্যমে ১৩তম জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের পক্ষেই। তিনি বলেন, গণভোটে ইতিবাচক ফল এলে পরবর্তী সংসদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধনের ক্ষমতা পাবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন জুলাই সনদ আইনি স্বীকৃতি পাবে গণভোটের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট হতে হবে।
এদিকে, সংসদ নির্বাচনের বাইরে ‘গণভোট’ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এখন নির্বাচন কমিশনের নেই। তবে সরকার সিদ্ধান্ত দিলে ইসি তা বাস্তবায়নে কাজ করবে। এমনই মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ।
তিনি বলেছেন, আমি কমিশনার হিসেবে বলছি না, দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যদি গণভোট করতেই হয়, তাহলে একদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট করলে কোটি কোটি টাকা বেঁচে যায়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে ‘সবাই’ একমত হয়েছে। বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পঞ্চম দফার বৈঠকের পর ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে আমাদের যে মতামত দিয়েছেন, জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে, সেটা হচ্ছে, একটি আদেশ জারি করতে হবে। ওই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে।
তবে সেই গণভোট কখন কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখনো মতভেদ আছে। কোনো কোনো দল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে করার প্রস্তাব দিয়েছে, তেমনি জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগেও গণভোট করার প্রস্তাব এসেছে।
১২ কোটি ৬৩ লাখের বেশি ভোটারের সংসদ নির্বাচনে থাকবে ৪০ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র, সেখানে ভোটকক্ষ থাকবে আড়াই লক্ষাধিক। প্রথমবারের মত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট নেওয়ার আয়োজন হচ্ছে ‘আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালটের’ মাধ্যমে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সংসদ নির্বাচনে ১০ লাখের বেশি লোকবল নিয়োজিত থাকবে। একসঙ্গে ভোট হলে এক আয়োজনেই দুই কাজ সেরে ফেলা সম্ভব। তা না হলে দুই দফায় একই মাপের আয়োজন করতে হবে দুই ভোটের জন্য। রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে সংসদ নির্বাচন; তার আগে ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা করবে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসি।
এখন প্রশ্ন হল, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তের পথ ধরে গণভোট যদি করতেই হয়, চার মাসের মধ্যে তা আয়োজনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কতটুকু আছে। গণভোট নিয়ে বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা কেমন, সেই আলোচনাও সামনে আসছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, গণভোট আর সংসদ নির্বাচন দুটো দুই জিনিস, আলাদা ব্যালট পেপারে হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে দুই রকমের ব্যালট পেপার প্রস্তুত, ব্যালট বাক্স আলাদা করতে হবে।
অতীতের তিন গণভোট :
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মতামত নেওয়ার পদ্ধতিই হল গণভোট। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চূড়ান্তভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের জন্য উপস্থাপিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে তিনবার গণভোট হয়েছে।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে প্রথম গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য। প্রদত্ত ভোটের ৯৮.৮% ‘হ্যাঁ’ ভোট; ১.১২% ‘না’ ভোট পড়েছিল।
১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দেশে দ্বিতীয়বার গণভোট হয় তখনকার রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকার বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত জানতে। মূলত সামরিক শাসকের বৈধতা দেওয়ার জন্য সেই গণভোট হয়েছিল। প্রদত্ত ভোটের ৯৪.১১% ‘হ্যাঁ’ এবং ৫.৫০% ‘না’ ভোট পড়েছিল সেবার।
১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৃতীয়বার গণভোট হয়। এ গণভোট ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সামনে প্রশ্ন ছিল- ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্টপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ ভবিষ্যতে দেশে কোন ধরনের সরকার পদ্ধতি চলবে, জনগণের কাছে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল এ প্রশ্নের মাধ্যমে। সেবার ৮৪% ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং ১৫.৬২% ‘না’ ভোট পড়েছিল।