সিলেটে ১৯ বছরের সর্বনিম্ন পাস : প্রায় অর্ধেক ফেল, গলদ কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ৩:২০:১৪ অপরাহ্ন

জালালাবাদ রিপোর্ট : সিলেটে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এইচএসসি) খারাপ ফলের রেকর্ড হয়েছে এবার। মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ফেল। পাসের হার ১৯ বছরের মাঝে সর্বনিম্ন ।
ফলাফলের সব সূচকই নিম্নমুখী এবার। গতবারের তুলনায় পাশের হার কমেছে ৩৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অবিশ্বাস্যভাবে কমেছে জিপিএ-৫। গত বছর জিপিএ-৫ ছিল ৬ হাজার ৬৯৮টি। এবার ৫ হাজার ৯৬টি কমে দাড়িয়েছে ১ হাজার ৬০২টিতে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীদের এমন ফলের গলদ আসলে কোথায়?
সিলেট বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর ২০০৬ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ক্রমেই বেড়েছে। ওই বছর পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এরপর এবারই সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমেছে।
গত ১৯ বছরের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, সিলেট বিভাগে এ বছর পাশের হার ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে পাশের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৩৯ ভাগ, ২০২৩ সালে ৭১ দশমিক ৬২, ২০২২ সালে ৮১ দশমিক ৪০, ২০২১ সালে ৯৪ দশমিক ৮০, ২০২০ সালে শত, ২০১৯ সালে ৬৭ দশমিক ৫, ২০১৮ সালে ৭৩ দশমিক ৭, ২০১৭ সালে ৭২, ২০১৬ সালে ৬৮ দশমিক ৫৯, ২০১৫ সালে ৭৪ দশমিক ৫৭, ২০১৪ সালে ৭৯ দশমিক ১৬, ২০১৩ সালে ৭৯ দশমিক ১৩, ২০১২ সালে ৮৫ দশমিক ৩৭, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ৬৮, ২০১০ সালে ৭৬ দশমিক ১২, ২০০৯ সালে ৭৩ দশমিক ৯৬, ২০০৮ সালে ৭১ দশমিক ১৭, ২০০৭ সালে ৬৫ দশমিক ৯৮ এবং ২০০৬ সালে ৬৫ দশমিক ৪৫ ভাগ।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরাসরি পরীক্ষা হয়নি, ফলে ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাই উত্তীর্ণ হন।গত বছর (২০২৪ সালে) পরীক্ষার্থীদের একাংশের চাপের মুখে মাঝপথে বাতিল করা হয়েছিল এইচএসসিতে স্থগিত হয়ে পড়া কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা। এ অবস্থায় তখন যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। আর যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল তৈরি হয়েছিল পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত ফলাফলে অনেকের ধারণা ও আশা ছিল পাসের হার অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত ফলাফল তুলে ধরেন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী।
বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এবারই পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে। তাছাড়া ইংরেজিতে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করায় ফলাফলে বিপর্যয় হয়েছে। এছাড়া ক্লাসে অনুপস্থিতি ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে দক্ষ শিক্ষকের অভাবও ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।
ফলাফলে দেখা গেছে, এ বছর শতভাগ পাস করেছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এর আগের বছর শতভাগ পাসের তালিকায় ছিল ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এবার একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চারটি। এটি বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম।
চলতি বছর সিলেট বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৬৯ হাজার ৯৪৪ জন। যার মধ্যে ৬৯ হাজার ১৭২ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৭৬৪ জন ছেলে আর ৪১ হাজার ৪০৮ জন মেয়ে। মোট পাশ করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৮৭০ জন। যার মধ্যে ছেলে ১৩ হাজার ৮৭০ এবং মেয়ে ২২ হাজার ১ জন।
মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৬০২ জন যার মধ্যে ছেলে ৬৮১ এবং মেয়ে ৯২১ জন। পাশের হারে পিছিয়ে রয়েছে ছেলেরা। ছেলে পরীর্ক্ষীদের মধ্যে পাশ করেছেন ৪৯ দশমিক ৯৬ জন আর মেয়েদের পাশের হার ৫৩ দশমিক ১৩ ভাগ।
প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী পাশের হার সবচেয়ে কম মানবিক বিভাগে। এই বিভাগে পাশ করেছেন ৪৫ দশমিক ৫৯ ভাগ পরীক্ষার্থী। আর বিজ্ঞান বিভাগে পাশের হার ৭৫ দশমিক ৯৫ ভাগ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৫০ দশমিক ১৮।
১ হাজার ৬০২ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্তের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে পেয়েছেন ১ হাজার ৩৭৯ জন, মানবিক বিভাগে ১৫৩ জন আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
সিলেট বিভাগে পাশের হার সবচেয়ে কম মৌলভীবাজারে। আর বেশি সিলেট জেলায়। সিলেটে পাশের হার ৬০ দশমিক ৬১ ভাগ, হবিগঞ্জে ৪৯ দশমিক ৮৮, সুনামগঞ্জে ৪৬ দশমিক ৩৫ এবং মৌলভীবাজারে ৪৫ দশমিক ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছেন।
যে কারণে সিলেটে পাসে ধস :
ফলাফল ধসের কারণ হিসেবে বোর্ডের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করোনা মহামারি, বন্যা পরিস্থিতি এবং ছাত্র আন্দোলনের কারণে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়নি। এবার পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষা ও ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্যের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া কলেজ শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি কম হওয়াও পাসের হার কম হওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, তবে সার্বিক ফলাফল ভাল হয়েছে। কারণ এবার সারাদেশেই গড় পাশের হার কম। ফলাফলে আমরা সন্তুষ্ট।
তিনি বলেন, সিলেট বোর্ডের পাসের হার বৃদ্ধি করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভাগভিত্তিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
৯ বোর্ডের মাঝে সিলেট ৬ষ্ঠ :
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, বরিশালে ৬২.৫৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৯.৪০ শতাংশ, দিনাজপুরে ৫৭.৪৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫২.৫৭ শতাংশ, সিলেটে ৫১.৮৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৫১.৫৪ শতাংশ, যশোরে ৫০.২০ শতাংশ এবং কুমিল্লায় ৪৮.৮৬ শতাংশ।এছাড়া মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৫.৬১ শতাংশ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬২.৫৭ শতাংশ।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৭ দশমিক ১২, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। অর্থাৎ এ বছর প্রায় ৪৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি। শুধু পাসের হার নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিপুল পরিমাণে কমেছে। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, তার আগের বছর পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৫২১ জন; কিন্তু এ বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।
গলদ কোথায় :
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা নির্দিষ্ট করে দিইনি যে এইভাবে নম্বর ছাড় দেবেন অথবা ওভারমার্কিং (যা প্রাপ্য নয়, তার চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া) করবেন, বেশি বেশি দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে, এ রকম কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, গত এসএসসি পরীক্ষার সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলে দেওয়া হয়েছে নিয়ম মোতাবেক চলবে। বোর্ড পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের নিয়মটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সঠিক মূল্যায়নের জন্য এবার সময়ও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রায় অর্ধেক পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি, আবার গ্রাম-শহরের ফলাফলেও ব্যাপক তারতম্য দেখা যাচ্ছে। সেটা কি দেশের শিক্ষায় যে বড় কোনো গলদের কথা বলা হয়, সেটিই এই ফলাফলে…? জবাবে অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এই যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না, এটা তো কাঙ্খিত নয়। এই বিষয়টিতে আমরা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি। তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, গলদ আছে, অবশ্যই গলদ আছে। সেই গলদের জায়গাগুলো ঠিক করতে হবে। সেই দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, সেই দায়িত্ব বোর্ডের, সেই দায়িত্ব সবার।
ফল বিপর্যয়ের উত্তর সহজ, কিন্তু অস্বস্তিকর :
এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল অনেককে বিস্মিত করেছে। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ আগের বছরের তুলনায় কম এবং প্রশ্ন উঠেছে-কেন? এর উত্তর জটিল নয় বরং সহজ, কিন্তু অস্বস্তিকর। বাংলাদেশে শেখার সংকট শুরু হয় খুব শুরুর দিকেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর সঞ্চিত হয়। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল-পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদÐ। আজ আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি।







