পার্কভিউ মেডিকেলে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণায় অচলাবস্থা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩০:০৫ অপরাহ্ন
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত

স্টাফ রিপোর্টার: নগরীর পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র গত চার দিন ধরে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত রেখেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবি আদায় না হলে লাগাতার ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ছাত্র রাজনীতিমুক্ত বেসরকারি এই মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
অভিভাবকরা বলছেন, বেসরকারি এই মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি না থাকায় সন্তানদের ভর্তি করেছেন অভিভাকরা। এখন সেখানে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতে এই মেডিকেল কলেজে সন্তানদের ভর্তি করতে আগ্রহ হারাবেন অভিভাবকরা । তারা বলছেন, অভিভাকরা চান না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে আবারো ছাত্র রাজনীতির পুরোনো সংস্কৃতি ফিরে আসুক। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে কার্যত ছাত্র রাজনীতি নেই। তাই এই কলেজে ছাত্রদল কমিটি দিয়ে জেন-জি প্রজন্মের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ সম্মানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। এখানে কোনো ছাত্র রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না। যারা এখানে ছাত্র সংগঠনের কমিটি এনেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলেজে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে দূর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তারা বলছেন, যে কারো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, সেটা কলেজের বাইরে গিয়ে চর্চা করতে পারে। সেটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে কলেজে কোনো কার্যক্রম সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না।
জানা গেছে, দূর্গা পূজার ছুটি শুরুর দিন গত ২৫ সেপ্টেম্বর শেখ রাহাতুল ইসলামকে সভাপতি, মোঃ ইয়াছিন ইবনে মাহবুবকে সাধারণ সম্পাদক, মোঃ আশিক সামিকে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জুম্মান সারওয়ারকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন সংগঠনের কেন্দ্র্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। ৩০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পূজার ছুটি শেষে গত ১২ অক্টোবর কলেজ খুললে বিষয়টি জানাজানি হয়। ছাত্র সংগঠনের কমিটি ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার ভৌমিক ও ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. মো. শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি, ছাত্রদলের কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কলেজের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ মর্মে বিল বোর্ড স্থাপন, ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্টভাবে অবহিত করা ও তা প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করার দাবি জানান।
দাবিসমূহ পূরণে শিক্ষার্থীদের কাছে দুই দিন সময় চান প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার ভৌমিক। দুই দিন পর গত ১৪ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা আবারো প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে অগ্রগতি জানতে চান। এসময় প্রিন্সিপাল শিক্ষার্থীদের জানান, এ বিষয়ে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, কলেজ ও হোস্টেলে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। নোটিশে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই দিন অর্থাৎ সোমবার (১৪ অক্টোবর) থেকেই ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। গত সোমবার থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করায় কলেজে কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
কলেজ সূত্র জানায়, ছাত্র রাজনীতি চালু করায় কলেজ ছাত্রদলের চার নেতাকে কলেজের মেডিসিন ক্লাবের সদস্য পদ, সন্ধানী ও নানান সামাজিক সংঘটন থেকে বহিস্কার করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সকল ক্লাব ও সামাজিকভাবে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
সূত্র জানায়, কলেজে ছাত্র রাজনীতি চালুর নেপথ্যে রয়েছেন ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. জিয়াউর রহমান চৌধুরী ও পার্কভিউ মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. মো. শাহাবুদ্দিন। পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার ভৌমিকের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে। তারপর যাতে প্রিন্সিপাল হওয়ার পথে কেউ বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়, এজন্য বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব নেতা অধ্যাপক ডা. মো. শাহাবুদ্দিন ছাত্র রাজনীতি চালু করে নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করতে চাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার কলেজের প্রিন্সিপাল বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। স্মারকলিপিতে বলা হয়, সম্পূর্ণ ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কমিটি প্রদান কলেজের শৃঙ্খলা বর্হিভূত কার্যক্রম। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্র্থীরা বেশ উদ্বিগ্ন। এতে আরও বলা হয়, কলেজের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী যেখানে ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে, সেখানে কলেজ প্রশাসন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন গড়িমসি করছে। কলেজ প্রশাসনের উপর একটি মহল বহিরাগত রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
কলেজ সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার চলমান ছাত্ররাজনীতি বিরোধী আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসে। বৈঠকে কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক ডা. শাখাওয়াত হোসেন শিক্ষার্থীদের উপর বারবার চড়াও হন বলে অভিযোগ উঠেছে। বৈঠকে ডা. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এটার পরিণাম ভালো হবে না। এ বক্তব্যে সম্মতি জানিয়ে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন শিক্ষার্থীদের এমন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন এবং কলেজ বন্ধ করার হুমকিও দেন। এমন পরিস্থিতিতে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।
তথ্য বলছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আইনে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কোনো উল্লেখ না থাকলেও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলবে কি না তা, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে প্রিন্সিপাল শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন বজায় রেখে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার দেওয়া আছে। ক্যাম্পাসের বাইরে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় অংশগ্রহণ করার বিষয় একান্তই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। আইনে বলা আছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজসমূহ তাদের পলিসি, শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আইনে শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে পৃষ্ঠপোষকতা না করা ও তাঁদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা রয়েছে।
আইনে শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে পৃষ্ঠপোষকতা না করা ও তাঁদের নিরাপত্তা বিধানের কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথায় ভ্রæক্ষেপ করছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজের সকল সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কলেজ প্রশাসনের কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না লক্ষ্য করায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী সকল ব্যাচের সকল শিক্ষা কার্যক্রম বয়কট অব্যাহত রেখছেন। যতদিন পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে, ততদিন পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।
মো. আব্দুল ওয়াদূদ নামের একজন অভিভাবক বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। পুরোনো স্টাইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসী ধারায় ফিরুক, কোনো অভিভাবক চায় না। অবিলম্বে কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে অভিভাবকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার ভৈৗমিক জালালাবাদকে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা ছাত্র রাজনীতি চালু করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।







