শাহজালালে অগ্নিকান্ড: ১৯ বার চিঠি পেয়েও ঘুম ভাঙেনি কর্তৃপক্ষের
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৮:২৭:৪৪ অপরাহ্ন

জালালাবাদ ডেস্ক: হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে গত শনিবার ভয়াবহ অগ্নিকাÐে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর দেশের বিমানবন্দরগুলোর অগ্নিনিরাপত্তায় বড়ো ধরনের গলদ থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। এমন কী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অভ্যন্তরীণ চিঠি চালাচালিও বলে দিচ্ছে বিমানবন্দরগুলোর অগ্নিনিরাপত্তায় বেহাল চিত্রের কথা। অগ্নিনিরাপত্তা বাড়াতে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে ১৯ বার চিঠি পাঠানো হয়েছিল বেবিচকের সংশ্লিষ্ট ইউনিট থেকে সদর দপ্তরে। এসব চিঠিতে ‘এয়ারক্রাফট রেসকিউ ফায়ার ফাইটিং ভিইকল’ জরুরি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে জোর তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯ বার চিঠি হাতে পেয়েও বেবিচক সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ঘুম ভাঙেনি।
জানা গেছে, দেশের আট বিমানবন্দরের উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহন দীর্ঘদিন ধরে অচলপ্রায় হয়ে পড়ে রয়েছে এমন অবস্থার কথা জানিয়ে বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টোর ইউনিট গত বছরের ১ এপ্রিল প্রথম বেবিচক সদর দপ্তরে চিঠি দেয়। চিঠিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের আটটি বিমানবন্দরের অগ্নিনির্বাপক যান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ৯ মে দ্বিতীয়বার চিঠি দেওয়া হয়। এভাবে একে একে ১৯ বার চিঠি পাঠানো হয়। সর্বশেষ চিঠিটি দেওয়া হয় গত ৩১ জুলাই। কিন্তু সদর দপ্তর সেসব চিঠিকে গুরুত্ব দিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে দেশের সব আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তায় বড় ধরনের গলদ রয়েই গেছে বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিমানবন্দরে ব্যবহৃত উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহনের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে অচল বা ত্রæটিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গত ৩১ জুলাই বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টোর ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়Ñ সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ১৯টি আলাদা তারিখে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য চিঠিপত্র পাঠানো হলেও সদর দপ্তর থেকে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
চিঠিতে যেসব তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলোÑ ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল, ৯ মে, ২৯ জুলাই, ২৭ আগস্ট, ৫ সেপ্টেম্বর, ৯ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ৯ ডিসেম্বর, ১১ ডিসেম্বর, ২২ ডিসেম্বর, ২৯ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি, ২০ মার্চ, ৯ এপ্রিল, ২৯ এপ্রিল, ২৩ জুন, ২৫ জুন, ৩০ জুন ও ৩১ জুলাই।
প্রতিটি চিঠির বার্তা অভিন্ন। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের যানবাহনের ত্রæটি, যান্ত্রিক সমস্যা ও জরুরি মেরামতের প্রয়োজনীয়তার বিবরণ পাঠান। কেন্দ্রীয় ইউনিটের পাঠানো মূল নথিপত্রে উল্লিখিত আরও বিভিন্ন সূত্র ও নথি কপি হিসেবে চিঠিতে সংযুক্ত করা হয়।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়Ñ বর্তমানে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চারটি যানবাহন (একটি প্রোটেক্টর, একটি রোজেনবাওয়ার ও দুটি মরিতা), শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনটি (একটি নাফকো ও দুটি টাইটান), ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪টি (একটি নাফকো, একটি রোজেনবাওয়ার ও দুটি টাইটান), কক্সবাজার বিমানবন্দরে দুটি, সৈয়দপুরে দুটি (একটি প্রোটেক্টর ও একটি রোজেনবাওয়ার), যশোরে একটি টাইটান, শাহ মখদুমে একটি টাইটান এবং বরিশালে দুটি যানবাহনসহ মোট ১৯টি উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় আনা প্রয়োজন। আরও বলা হয়- ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বিমানবন্দরকে নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে হলে কার্যকর অগ্নিনির্বাপক যানবাহন সার্ভিসেবল রাখা অত্যাবশ্যক। কিন্তু এসব যানবাহন দীর্ঘসময় অচল থাকায় বিমানবন্দরের অপারেশন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং ভবিষ্যতে বিমানবন্দরগুলোর শ্রেণি বা ক্যাটাগরি কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন কোনো সংশোধনাত্মক কার্যক্রম না নেওয়ার ফলে ক্ষুদ্র ত্রুটিগুলো বড় ত্রুটিতে পরিণত হতে পারে এবং একেবারে মারাত্মক ত্রæটির কারণে বিমানবন্দরকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে মেরামত করতে হতে পারে। এতে অপারেশন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অডিট আপত্তি হতে পারে বা বিমানবন্দরের ক্যাটগরি ডাউন হয়ে যেতে পারে।
চিঠিতে জরুরি প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান এবং দ্রুত প্রাক্কলন অনুলিপি পর্যালোচনার জন্য সদর দপ্তরের প্রতি শক্তিশালী অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও ঘুম ভাঙেনি কর্তৃপক্ষের।
বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথম প্রতিরক্ষা হলো ওই অগ্নিনির্বাপক যানবাহনগুলো। যদি এসব যানবাহন কাজে না আসে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনক কোনো ঘটনার ত্বরিত প্রতিকারের সম্ভাবনা সীমিত থাকবে। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক পরিদর্শন বা অডিটে যদি এই তথ্য ওঠে আসে, তাহলে দেশের বিমানবন্দরগুলোকে অনুক‚লভাবে বিবেচনা করা নাও হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটসহ নানা ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাহী পরিচালকের চিঠির চাহিদানুযায়ী অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রী এবং বিমান উভয়ের নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে যে কোনো সময়। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ও দ্রুত পদক্ষেপই এখন এর একমাত্র সমাধান।
বেবিচক সদস্য (অপারেশন) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান বলেন, যে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোয় রক্ষণাবেক্ষণ ও কেনাকাটায় অত্যধিক ব্যয় ধরা হয়েছে। আমরা যাচাই-বাছাই করছি। কোনটির প্রয়োজনীয়তা আছে, আর কোনটির নেই; সেটাও আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ব্যাপারে দ্রæত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।





