সামলানো যাচ্ছে না সার সিন্ডিকেট
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ৭:৫২:৪৪ অপরাহ্ন

জালালাবাদ ডেস্ক: সারাদেশে থাকা সারের ডিলারদের শক্ত সিন্ডিকেট ভাঙতে চেয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য প্রণয়ন করা হয় নতুন নীতিমালা। এতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভার জন্য পৃথক নিয়ম বা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে করে সারের কৃত্রিম সংকট দূর করা সম্ভব এবং চড়া দাম নির্ধারণের সুযোগ থাকবে না। এতে ক্ষেপে যায় ডিলার সিন্ডিকেট। তারা এখন যে কোনো উপায়ে সারের জন্য সংশোধিত নীতিমালা পেছানোর জন্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য- আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার আসার আগ পর্যন্ত তা কার্যকর করতে না দেওয়া। আপাতত সফল হলে পরবর্তীতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের কাউকে ভুল বুঝিয়ে বা ‘ম্যানেজ’ করা সম্ভব বলে ধারণা করছে সার সিন্ডিকেট।
ডিলার সিন্ডিকেটের নীতিমালা নিয়ে আপত্তির জায়গা হলো- নতুন নীতিমালায় সরকারি কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, ফৌজদারি অপরাধে দন্ড পাওয়া ব্যক্তি, একই পরিবারের একাধিক সদস্য ডিলার হতে পারবেন না। অবশ্য এতে করে সার নিয়ে কারসাজি অনেকটা রোধ হবে বলে মনে করছে সরকার। একাধিক উৎস থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র মতে, ডিলারচক্রের অবৈধ মজুদের কারণে বাড়তি দামে সার কিনতে বাধ্য হন কৃষক। এটি বন্ধ করতেই সংশোধন করা হয় নীতিমালাটি। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে নীতিমালাটি কার্যকর হবে বলে বলছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে সার চক্রের লোকজন নীতিমালাটি ঠেকাতে সাধারণ ডিলারদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা, ভীতি প্রদর্শন, এমনকী নানা কায়দায় নীতিমালার বিপক্ষে জনমত তৈরিতে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে অর্জন করা
‘সোনার হাঁস’ নাই হয়ে যাওয়া মানতে চাইছে না তারা। তাই রাজনৈতিক সংযোগও খুঁজছে চক্রটি। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষক, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সারের দুষ্টুচক্রটি বলছে- সার সংকট হতে পারে। তবে সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত সার মজুদ আছে। যেভাবে সার আসছে ভবিষ্যতেও সার সংকটের কোনো শঙ্কা নেই।
জানা গেছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সার বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভায় নীতিমালার চ‚ড়ান্ত অনুমোদন পরে জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হতে পারে। এ সময়টা ঠেকিয়ে রাখতে জোর দিয়েছে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ব্যানার ব্যবহার করা হচ্ছে। পেছনে রয়েছে সংসদ সদস্য ও পোটন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কামরুল আশরাফ খান পোটনের সহযোগীসহ একটি চক্র।
কৃষি সচিব ড. মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটি তিনটি সভার মাধ্যমে নীতিমালাটি চ‚ড়ান্ত হয়েছে। এখন থেকে কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে সার পাবেন। সার বিক্রয়ের দায়ভার থাকবে ডিলারের ওপর, আমরা ডিলারকেই জবাবদিহির আওতায় আনব।
জানা গেছে, পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলারের চক্রটি খুবই শক্তিশালী। এরা সরকারের আমদানি করা সার বন্দর থেকে গায়েব করে উল্টো ১৩টি মামলা করেছিল- এমন দৃষ্টান্তও আছে। সারের দাম বাড়ানো হয় সিন্ডিকেটের কৌশলে। যেমন ডিলার ২৫ টাকা দরে সাব ডিলারের কাছে ২৭ টাকায় বিক্রি করে সার। এরপর তিনি খুচরা বিক্রেতার কাছে আরও বেশি দামে বিক্রি করেন। তারপর আরও বাড়তি দামে কৃষককে কিনতে হয়। সাব ডিলার সংকট দেখান। খুচরা বিক্রেতা তখন অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য হন। ফলে কৃষক চ‚ড়ান্তভাবে চড়া দামের শিকার হন। সার বিক্রির এই হাতবদলটা বন্ধ করতে এবার বলা হয়েছে- ডিলারের নির্দিষ্ট এলাকায় সেলস পয়েন্ট বা বিক্রির স্থান থাকতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি সার পাবেন কৃষক।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগে ডিলারশিপ জামানত ছিল ২ লাখ টাকা। নতুন নীতিমালায় তা ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রতি বছর ১ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ডিলারশিপ নবায়ন করতে হবে জেলা প্রশাসকের কাছে। নবায়ন ফি ২ হাজার টাকা, দেরি করলে (১৬ আগস্ট পর্যন্ত) অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হবে। সময়সীমা পেরিয়ে গেলে ডিলারশিপ সাময়িক বাতিল হবে। আবেদনকারীর ৫০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গুদামসহ বিক্রয়কেন্দ্র থাকতে হবে। আবেদনকারীকে আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ হিসেবে ১০ লাখ টাকার ব্যাংক সনদ দেখাতে হবে। ইতোপূর্বে শাস্তি হিসেবে ডিলারশিপ বাতিল হলে আবেদনের অযোগ্য হবেন।
তথ্য মতে, আগের নীতিমালায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি ছিল। একে বলা হয় সার ও বীজ মনিটরিং কমিটি। এখন বিভাগীয় পর্যায়েও কমিটি থাকবে। এরপর মন্ত্রণালয় তা মনিটরিং করবে। জেলা কমিটি ডিলারদের লাইসেন্স দেবে। এটিকে বলা হয় জাতীয় কমিটি। এ পদ্ধতির কারণে সার সরবরাহে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ছাড়া বিএডিসি ও বিসিআইসি এক ছাতার নিচে চলে আসবে। কৃষককে হয়রানি মুক্ত করতেই এমন উদ্যোগ। ডিলার নিয়োগের প্রস্তাব যাচাই করবে জেলা সার ও বীজ তদারকি কমিটি। জেলা পর্যায়ে যাচাই শেষে আবেদন যাবে কেন্দ্রীয় ডিলার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে। পরে জেলা কমিটি চ‚ড়ান্ত নিয়োগ দেবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, নীতিমালার বাস্তবায়ন ঠেকাতে কিছু প্রভাবশালী সার ব্যবসায়ী মাঠে সক্রিয়। তাঁরা সার মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে চাইছে। এটি পুরনো চক্রের চাপ সৃষ্টির কৌশল। নতুন নীতিমালার মাধ্যমে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া দুই ধরনের সারই একক ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ ও বিতরণ করা হবে। এক উপজেলার বরাদ্দ করা সার অন্য উপজেলায় বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না। যদি কোনো ডিলার আর্থিক কারণে ব্যবসা চালাতে না চান, তবে উপজেলা কৃষি অফিসে আবেদন করে ডিলারশিপ সমর্পণ করতে পারবেন, তবে তা একবারের জন্য প্রযোজ্য হবে। ডিলার মারা গেলে বা অসুস্থ হলে জেলা সার ও বীজ তদারকি কমিটি সন্তোষজনক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রতি ইউনিয়নে তিনটি, পৌরসভায় একটি এবং সিটি করপোরেশনে প্রয়োজন অনুযায়ী ডিলার ইউনিট থাকবে। কোনো ডিলারশিপ খালি হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রতি ডিলারের অধীনে তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে একটি মূল গুদাম এলাকায় এবং বাকি দুটি ওয়ার্ডের সুবিধাজনক স্থানে। প্রতি কেন্দ্রে সারের নাম, বিক্রয়মূল্য ও সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সব বিক্রয়কেন্দ্রে ক্যাশ মেমোতে বিক্রয়, উত্তোলন রেজিস্টার, রক্ষণাবেক্ষণ ও ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।
কোনো ব্যক্তি একটির বেশি ডিলারশিপ পাবেন না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ডিলারশিপ বাতিল হয়ে যাবে। নীতিমালা অনুযায়ী সার ডিলার-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সদস্যের নেতৃত্বে ছয়জন, বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ১৫ জন, জেলা কমিটিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ১৯ জন সদস্য থাকবেন।







