বহুমাত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস সিলেট-৫ আসনে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ৬:৩৫:৪৮ অপরাহ্ন

এখলাছুর রহমান, জকিগঞ্জ : সিলেট-৫ আসন (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পালাক্রমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে, জনগণ সবসময় নেতৃত্ব নির্বাচনে ব্যক্তিত্ব, উন্নয়নমুখী ভাবনা ও ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুজ জহুর জয়ী হয়ে স্থানীয় উন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে আবুল হাসনাত মো. আব্দুল হাইও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মাহমুদুর রহমান মজুমদার আসনটি দখল করেন। গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুল হক বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপি নেতা আবুল কাহের চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমেদ মজুমদার জয়লাভ করেন। ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে হাফিজ আহমেদ মজুমদার পুনরায় জয়ী হন, ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির সেলিম উদ্দিন নির্বাচিত হন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা হুসাম উদ্দিন চৌধুরী সংসদ সদস্য হন।
২০২৬ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট-৫ আসন চারটি প্রধান শিবিরের প্রতিদ্ব›িদ্বতার মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের মধ্যে চতুর্ম‚খী লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী। যাদের মধ্যে রয়েছেন, মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন), জাকির হোসাইন, আশিক উদ্দিন চৌধুরী, ভিপি মাহবুবুল হক চৌধুরী, সিদ্দিকুর রহমান পাপলু ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান জামান। তবে দলীয় বিভাজন ও একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্ব›িদ্বতা বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনাকে সীমিত করে তুলছে। শুনা যাচ্ছে, কানাইঘাট উপজেলা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী তনয়া ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীও এই আসন থেকে প্রার্থী হতে আগ্রহী। এমনটা হলে বিএনপির ভোট ব্যাপকভাবে ভাগাভাগি হবে। খোদ হারিছ চৌধুরীর বাড়ির ভোটগুলোও ভাগাভাগি হতে বাধ্য। একদিকে চাচা আশিক উদ্দিন চৌধুরী, অন্যদিকে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রার্থী হতে ইচ্ছুক বিএনপি নেতারা যদি সকল ভেদাভেদ ভুলে দলীয়ভাবে একক প্রার্থী দিতে সক্ষম হন তাহলে স্বাধীনতার পর তাঁরা দ্বিতীয়বারের মতো এমপি পদটি বাগিয়ে নিতে পারবেন। তাঁদের মতে, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় জকিগঞ্জ-কানাইঘাট অঞ্চলে বিএনপির দলীয় তৎপরতা অনেক বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি প্রার্থী শরিফ লস্কর বলেন আমি দীর্ঘদিন যাবৎ বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। ইদানীং আমার নেতৃত্বে প্রতিদিনই মিছিল মিটিং অব্যহত আছে। আমাকে প্রার্থী দিলে বিজয় সুনিশ্চিত। সাবেক ভিপি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন) বলেন, প্রায় তিন মাস আগেই আমার দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির প্রার্থী সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমি প্রার্থী হতে পারলে ইনশাআল্লাহ ভালো ফলাফল আসবে। তারপরও জনগণ না চাইলে এমপি নাইবা হলাম,মানুষের সেবা এমপি না হয়েও করা যায়।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আনোয়ার হোসাইন খান একক প্রার্থী হিসেবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তাঁর মূল ঘাঁটি কানাইঘাট হলেও জকিগঞ্জেও জামায়াত সমর্থিত প্রচুর ভোটার রয়েছেন। তবে জমিয়তের প্রার্থী মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক প্রার্থী হওয়ায় কানাইঘাট উপজেলার ভোটের একটি বিরাট অংশ তাঁর বাক্সে চলে যাবে। এছাড়া কানাইঘাটের ভোটে ভাগ বসাবেন আশিক উদ্দিন চৌধুরী, চাকসু মামুন, মাওলানা রেজাউল করিম আবরার ও ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীর মত হেভিওয়েট প্রার্থীরা।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে মাওলানা আনোয়ার হোসাইন খান বলেন, আমি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার বিষয়ে পুরোদস্তুর আশাবাদী। আমি জকিগঞ্জ-কানাইঘাটবাসীকে আমার বুক দিয়ে ধারণ করি। আওয়ামী দুঃশাসন যুগ থেকে এ পর্যন্ত আমি এতদ্বাঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে আছি, ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ ২০০১ এর চেয়েও ভালো ফলাফল করে জামায়াত প্রার্থী হিসাবে এই আসনের এমপি নির্বাচিত হবো।
জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুকও নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। কওমি ভোটারের একাংশ তাঁর পক্ষে থাকলেও ভোটের মওসুম ছাড়া বাকি সময় নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকার কারণে সাধারণ ভোটারদের থেকে তিনি যথাযথ সমর্থন আদায় করতে পারবেন না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এছাড়া এ নির্বাচনে কওমি ধারার খেলাফত মজলিসের মুফতি মাওলানা আবুল হাসানও অংশ নিচ্ছেন। ফলে ইসলামপন্থী ভোট বিভাজিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জমিয়ত নেতা হাফিজ যুবায়ের আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি জানান, জকিগঞ্জ-কানাইঘাট ইসলামপ্রিয় জনতার পূণ্যভ‚মি। এই আসনে এবার উবায়দুল্লাহ ফারুক বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন ইনশাআল্লাহ।
মুফতি আবুল হাসান জকিগঞ্জ কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও খতিব। খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফুলতলী ঘরানার বেশিরভাগ ভোটও তাঁর বাক্সে চলে আসতে পারে। ইতিহাসও প্রমাণ করে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁর আত্মীয় মাওলানা উবায়দুল হক উজিরপুরী অনুরূপ পরিস্থিতিতে জয়ী হয়েছিলেন।
আগামী নির্বাচনে তাঁর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিলেট জেলা খেলাফত মজলিসের সহ-সভাপতি মাওলানা মুখলিছুর রহমান বলেন, মুফতী আবুল হাসান জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত নাম। ওয়াজ, শিক্ষকতা ও ইসলামি আইন গবেষণার পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে তৎপর। আছে তাঁর ক্লিন ইমেজ ও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভোটের চ‚ড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করবে- জোট ও মহাজোট গঠনের কৌশল, প্রার্থী সমন্বয় এবং প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের ওপর। স্পষ্ট যে, ২০২৬ সালের নির্বাচন হবে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের সবচেয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ ও বহুমাত্রিক নির্বাচন, যেখানে ইতিহাস, জনপ্রিয়তা এবং দলীয় বিভাজন মিলিয়ে ফলাফল নির্ধারিত হবে।





