২ বছরে দেড় লাখ মৃত্যু ও দেড় কোটি বাস্তুচ্যুত সুদানে আসলে কী হচ্ছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ৯:১৮:২৯ অপরাহ্ন

জালালাবাদ রিপোর্ট : দশের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী আর প্যারামিলিটারি গ্রুপ র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে সেসময় থেকে শুরু হয় সশস্ত্র সংঘাত।দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ঐ সংঘাতে সুদানজুড়ে মারা গেছে দেড় লাখের বেশি মানুষ। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
সম্প্রতি পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের শহর আরএসএফ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর সেখানে তারা গণহত্যা চালিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বর্তমানে সুদানে চলছে। সুদানে কেনো এই পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
কেন গৃহযুদ্ধ সুদানে?
সুদানে এখন যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সালে তিন দশক ধরে প্রেসিডেন্ট থাকা ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে। ১৯৮৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সুদানের ক্ষমতায় আসা ওমর আল-বশিরকে পদ থেকে সরাতে ২০১৯ সালে সুদানে বিপুল মাত্রায় বিক্ষোভ হয়। তার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পতন ঘটায়।
দেশের ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী। তবে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। বিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে সরকার প্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আরেকটি অভ্যুত্থানে ঐ সরকারও ক্ষমতাচ্যুত হয়। ঐ অভ্যুত্থানের পেছনে মূলত যেই দুইজন ব্যক্তি ছিলেন, তারাই সুদানে চলমান সংঘাতের পেছনে রয়েছেন। এরা হলেন- জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট।
অন্যদিকে দেশটির উপ-নেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। তিনি হেমেডটি নামেই বেশি পরিচিত।
অল্প কিছুদিন আগেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসাথে কাজ করেছেন। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কিন্তু এক পর্যায়ে আগামীতে দেশটি কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়েই এই দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। বিশেষ করে সুদানের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে তারা ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেন।
মনে করা হয়, দুই নেতাই তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব বজায় রাখতে চাওয়ায় দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।তাদের দ্বন্দ্বের পেছনে অন্যতম ইস্যু ছিল আরএসএফের এক লাখের বেশি সৈন্যকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়ার প্রশ্নে। এই সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হলে নতুন বাহিনীকে কে নেতৃত্ব দেবেন সেটি নিয়েও দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই নেতার মধ্যে।
দুই নেতার মধ্যে এমন উত্তেজনা চলাকালীন অবস্থায় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে আরএসএফ সেনাদের সুদানের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তকে সেনাবাহিনী হুমকি হিসেবে দেখে। যার ধারাবাহিকতায় সে বছরের ১৫ই এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই আরএসএফের সেনারা রাজধানী খার্তুমের একটা বড় অংশ দখল করে নেয়। সেনাবাহিনী প্রায় দুই বছর পর, ২০২৫ সালের মে মাসে, খার্তুমের দখল ফিরে পায়।
সুদানে কি গণহত্যা চলছে?
দারফুরের বহু মানুষ বিশ্বাস করে যে আরএসএফ ও তাদের সাথে জোটবদ্ধ মিলিশিয়া গোষ্ঠী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত অঞ্চলটিকে আরব শাসিত একটি এলাকায় পরিণত করতে চায়।
গত বছরের মার্চে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এমনও তথ্য দিয়েছে যে সশস্ত্র সেনারা এক বছর বয়সী শিশুদেরও ধর্ষণ করেছে এবং যৌন নির্যাতন করেছে। এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় শিশুদের অনেকে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছে।
এছাড়া গত বছরের মার্চেই দারফুরের স্থানীয় মাসালিট গোষ্ঠী ও আরব নয় এমন কিছু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরএসএফ ও তাদের সশস্ত্র জোটসঙ্গীরা গণহত্যা চালানোর চেষ্টা চালিয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ঐ অঞ্চলে করা জাতিসংঘের তদন্তে উঠে আসে যে আরএসএফের গণহত্যা ছাড়াও সুদানের সেনাবাহিনীও ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত।জাতিসংঘের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে তাদের কাছে এমন বক্তব্যও রয়েছে যে আরএসএফ সেনারা যৌন আক্রমণ করার সময় অনারব নারীদের উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য করেছেন যে তাদের গর্ভে জোরপূর্বক ‘আরব সন্তান’ দেয়া হবে।
এখন এল ফাশের অঞ্চল থেকে আসা সহিংসতা ও গণহত্যার যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ঐ অঞ্চলে থাকা প্রায় আড়াই লাখ মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই আড়াই লাখ মানুষের একটা বড় অংশ জাতিগভাবে আরব নয়। সুদান উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ এবং আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম দেশগুলোর একটি। সুদানের আয়তন প্রায় ১৯ লাখ বর্গ কিলোমিটার।






