সিলেট অঞ্চলের প্রাথমিকের বেহাল দশা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩:০০:১৯ অপরাহ্ন
* ১৯৩১ স্কুলে নেই প্রধান শিক্ষক *
* সহকারী শিক্ষকের ২৪৮৯ পদ শুন্য *
* বিদেশ গমনে ৩ বছরে বরখাস্ত ৩৩১ *

এমজেএইচ জামিল: শিক্ষক সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে প্রাথমিকের শিক্ষা কার্যক্রম। বিশেষ করে দুর্গম ও হাওরাঞ্চলে এই অবস্থা খুবই করুণ। সিলেট বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষার এমন বেহাল দশায় উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও সচেতন নাগরিকবৃন্দ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ টি জেলার ১ হাজার ৯৩২টি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে নেই প্রধান শিক্ষক। এসব স্কুলে ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চলছে কার্যক্রম। এছাড়া ২ হাজার ৪৮৯ টি সহকারী শিক্ষকের পদও শুন্য রয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান, ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষা কার্যক্রমে।
এদিকে শিক্ষক ও জনবল সংকটে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রাইমারী শিক্ষকদের বিদেশমূখীতা। সিলেট অঞ্চলের শিক্ষকদের গায়ে লেগেছে প্রবাসের হাওয়া। হাজারো তদবির ও কঠোর পরিশ্রম করে একটি সরকারি চাকুরী কপালে জুটলেও, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের স্বপ্নে এই অর্জন নিমিষেই শেষ করছেন তারা। এতে একদিকে স্কুলে দেখা দিয়েছে শিক্ষক শূন্যতা, অপরদিকে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ বছরে সিলেট বিভাগে ছুটি না নিয়েই বিদেশে চলে যাওয়ার অভিযোগে ৩৩১ জন প্রাইমারী শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৪৭ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। বরখাস্ত হওয়া শিক্ষকদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিলেট জেলা, ২য় স্থানে সুনামগঞ্জ, ৩য় স্থানে মৌলভীবাজার। সবচেয়ে কম বরখাস্ত হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলায়।
চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী সিলেট বিভাগের চার জেলার ৫ হাজার ৫৪টি বিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষকের পদ শুন্য রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৩২ টি প্রধান শিক্ষক ও ২ হাজার ৪৮৯ টি সহকারী শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। এছাড়া বিভাগের ৪ জেলায় অফিস সহকারী, এমএলএসএস ও নৈশপ্রহরী সহ আরো সহস্রাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারীর পদ খালি রয়েছে।
বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলে মোট ২৫ হাজার ৮৮৯ জন সহকারী শিক্ষকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ২৩ হাজার ৪০০ জন। এরমধ্যে খালি রয়েছে ২ হাজার ৪৮৯ টি পদ।
জানা গেছে, সিলেট জেলায় ৭ হাজার ৮৬৭ টি সহকারী শিক্ষক পদের বিপরীতে শুন্য রয়েছে ৭৩০ টি, সুনামগঞ্জে ৭ হাজার ২৫৮ টি পদের বিপরীতে শুন্য রয়েছে ১০২৮ টি, হবিগঞ্জে ৫ হাজার ৪২৫ টি পদের বিপরীতে শুন্য রয়েছে ৪৩৭ টি ও মৌলভীবাজারে ৫ হাজার ৩৩৯টি পদের বিপরীতে ২৯৪ টি সহকারী শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে।
এছাড়া সিলেট বিভাগে ৫ হাজার ৫৪ টি প্রধান শিক্ষকের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ৩ হাজার ১২২ জন। এরমধ্যে ১ হাজার ৯৩২ টি পদ খালি রয়েছে। এরমধ্যে সিলেট জেলায় ১ হাজার ৪৭৭টি পদের বিপরীতে খালি রয়েছে ৭৭৮টি, সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৪৭৫ টির পদের বিপরীতে ৩৬৫ টি, হবিগঞ্জে ১ হাজার ৫২টি পদের বিপরীতে ২৪৬টি ও মৌলভীবাজারে ১ হাজার ৫০টি পদের বিপরীতে ৫৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে।
জানা গেছে, একসাথে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের পদ খালি থাকায় পাঠদান চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত শিক্ষকদের। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান, ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষা কার্যক্রমে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুন্যপদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়ে ভ্রমণ বা কাজের ভিসায় বিদেশে চলে যান। এরপর তারা কয়েক মাস বেতন ভাতাও উত্তোলন করেন। কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তারা বিষয়টি দীর্ঘদিন গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে সবকিছু প্রকাশ পায়। তখন বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এরপর চলে দীর্ঘ তদন্ত। কিন্তু কেউ যোগাযোগ না করা স্বত্তেও এই তদন্তে সময় যাচ্ছে মাসের পর মাস। তাই পদটি শুন্য দেখানো সম্ভব হয়না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে সিলেট বিভাগের ৪টি জেলার ৩৭৮ জন প্রাথমিকের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছুটি না নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এসবের মধ্যে ৩৩১ জনের মামলা নিষ্পত্তি করে তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া ৪৭ জনের মামলা এখনো তদনীন্তন থাকলেও প্রায় সবাই বরখাস্ত হওয়ার পথে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলায় ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় ১৬৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। দীর্ঘ শুনানী ও তদন্ত শেষে এখন পর্যন্ত ১৪০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ মামলা ও শিক্ষক বরখাস্তের ঘটনা ঘটেছে সিলেট জেলায়। জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একঝাঁক শিক্ষক ছুটি না নিয়েই বিদেশে চলে গেছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন তারা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ বছরে সুনামগঞ্জ জেলায় ছুটি না নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ায় অর্থাৎ দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১২১ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে অধিদপ্তর। দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানী শেষে এখন পর্যন্ত ১১৬ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে ৫৩ জনকে বরখাস্ত হয়েছে। এছাড়া মামলা চলমান রয়েছে ১২ জনের বিরুদ্ধে। মামলাগুলো নিষ্পত্তির শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলাটিতে গত ৩ বছরে ছুটি না নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার অভিযোগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত ২২ জন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। এগুলোও নিষ্পত্তির শেষ পর্যায়ে আছে।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, এত বেশী সংখ্যক শিক্ষকের পদ শুন্য থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। অন্যান্য শিক্ষকদের উপরও চাপ পড়ছে। এরপরও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ধাপ থাকে এবং সেটি সময়সাপেক্ষ তাই চাইলেও সমাধান করা যায়না।
তিনি বলেন, তবে আশার দিক হচ্ছে- মামলাজনিত কারণে কয়েক বছর থেকে প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে জটিলতা ছিল সেটি দূর হয়েছে। ইতোমধ্যে পিএসসি সার্কুলার দিয়েছে। আশা করা যায় কয়েক মাসের মধ্যে প্রধান শিক্ষক সংকট দুর হবে। আর সহকারী শিক্ষক নিয়োগেরও সার্কুলার রেডি। সেটি যেকোন সময় ঘোষণা হতে পারে। ৪/৫ মাসের মধ্যে এটিরও সমাধান হবে।
ছুটি না নিয়ে বিদেশে যাওয়া শিক্ষকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ছুটি ছাড়া ৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে বিদেশে থাকার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হলেও তাদেরকে জরিমানা করার কোনো বিধান নেই।






