শাবির হলে ‘আদু ভাই’ যুগের অবসান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ৯:০৮:৩৯ অপরাহ্ন
আসন বণ্টনে মেধাকে অগ্রাধিকার

হোসাইন ইকবাল, শাবিপ্রবি প্রতিনিধি : গত দেড় বছরে বদলে গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আবাসিক হলের চিত্র । হলে নেই দীর্ঘদিনের চিরচেনা ছাত্রলীগের গ্রুপিং রাজনীতি, টর্চার সেল, গাঁজা খাওয়ার আসর ও আধিপত্য বিস্তার। হলে সংঘর্ষের বদলে হলে ফিরেছে পড়ালেখার পরিবেশ। কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী হওয়া এখন আর আবাসিক হলে আসন পাওয়ার যোগ্যতা নয়, হলে আসন পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা একাডেমিক ভালো ফলাফল। সেই সংস্কৃতি বদলে দিয়েছেন বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জুলাই অভ্যুত্থানের ফলেই এই অসাধ্য পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, একসময় আবাসিক হলে আসন পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা ছিল ছাত্রলীগের সদস্য হওয়া। হলে পড়াশোনার কোনো পরিবেশও ছিল না। নিয়মত চলতো গাঁজা খাওয়ার আসর। শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্রের বদলে ফিরেছে কলম আর বই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের ভয় নেই। একাডেমিক পড়াশোনা ও এক্সট্রা কারিকুলামই এক্টিভিটিজই শিক্ষার্থীদের জীবনের নিয়মিত অংশ। ফলে পড়ালেখার মান উন্নত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা গবেষণামুখী হচ্ছে। যার ফলাফল আগামী কয়েক বছরেই দৃশ্যমান হবে।
তথ্য বলছে, শাহপরাণ হলে ২০৯ নম্বর থাকতেন খলিলুর রহমান। তিনি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ২০১৩ সালে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হওয়া এই নেতা ২০২৪ সালেও আবাসিক হলে থাকতেন। দীর্ঘ ১১বছর ধরে নিষিদ্ধ এই নেতা হলে কক্ষ দখল করে একাই থাকতেন। ক্যাম্পাসে তিনি ‘মৎস খলিল’ নামে পরিচিত হলেও আদুভাই নামেও ডাকা হতো।
গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে হল থেকে পালিয়ে যান এই নেতা। শুধু খলিল নয়, এমন ডজন-ডজনখানেক নেতা বৈধ শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চিত করে অবৈধভাবে আবাসিক হলে থাকতেন। তবে জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যা ও নাশকতার মামলায় কারাগারে দিন কাটছে তাদের কয়েকজনের। এভাবেই অবসান হয়েছে ‘আদু ভাই’ যুগের। হলে এখন বৈধভাবে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। গত বছরের ৯ অক্টেবরে আবাসিক হলে মেধা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীরা আসন পেয়ে হলে উঠেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে শাবিপ্রবির আবাসিক ছাত্রহলগুলো নানা অনিয়মে জর্জড়িত ছিল। গণরুম, জোর করে রুম দখল, পরিচয় পর্বের নামে সারারাত ধরে নির্যাতন, বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, গ্রুপ, সাব গ্রুপ তৈরি, নেতাদের মাদক সেবন, ডাইনিং ও ক্যান্টিনে ফাঁও খাওয়া-এসব ছিল ছাত্রলীগের দৈনন্দিন কার্য। কাগজপত্রে প্রশাসনিক ব্যক্তি নিয়োগ হলেও কার্যত নিয়ন্ত্রণ করত নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের আদুভাই নামক নেতারা। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান পুরো চিত্রটাই পাল্টে দেয়। দীর্ঘদিনের দখলদারিত্বের অবসান ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা বলছে, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে হলগুলোর সার্বিক পরিবেশ বদল হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজয় চব্বিশ হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রলীগের সময় যখন আমারা হলে উঠেছিলাম তখন আমাদের বাধ্যতামূলক গণরুমে থাকতে হতো। সেখানে পরিচয় পর্ব, রাতে র্যাগিংসহ নানা বিষয় ছিল। এছাড়া নেতাদের ম্যানেজ করে সিঙ্গেল সিটে উঠা লাগতো। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক আসন বরাদ্দ দেওয়ায় অন্য কারও ম্যানেজ করা বা কোনো রাজনৈতিক দলের গোলামি করতে হচ্ছে না। যা পুরো হলের পরিবেশ পরিবর্তন করে দিয়েছে বলে আমি মনে করি।
সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসলিমা খানম বলেন, আগে হলে যে রাজনৈতিক চাপ, মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের অধীনে হলে ওঠার অনানুষ্ঠানিক নিয়ম চালু ছিল, সেই সংস্কৃতি বদলে গেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্রভাব শুধু শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করত না, অনেক শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ ও স্বচ্ছল আবাসিক জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত।
জানতে চাইলে বিজয় চব্বিশ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো জামাল উদ্দিন জালালাবাদকে বলেন, বর্তমানে হলের শতভাগ শিক্ষার্থী বৈধ। এখানে ‘বড় ভাই’ কনসেপ্ট নাই। প্রথম দিকে ৬০ ভাগ মেধা আর পরে ৪০ ভাগে দরিদ্র, উপজাতি, খেলোয়াড়দের আসন দেওয়া হয়েছে। এসব আসন বিভাগের সুপারিশের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অভ্যুত্থানের আগে ৫২৮টির মধ্যে মাত্র ১১২টি আসন বরাদ্দ ছিল। বর্তমানে হলের সব দল বা মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা সোহাদ্য পূর্ণ পরিবেশে আবাসিক হলগুলোতে থাকছে। বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তড়িৎ প্রকৌশলসহ বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরাও হলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. এ. এম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী জালালাবাদকে বলেন, আমরা হলগুলোতে প্রথম থেকেই মেধার ভিত্তিতে এবং কিছু দারিদ্রের কোটায় আসন বরাদ্দ দিয়ে আসছি, যার ফলে আসন বন্টনে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এছাড়া আমরা হলগুলোর ডাইনিং-ক্যান্টিনর পরিবেশ সুন্দর করার চেষ্টায় আছি। যাতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বজায় থাকে। হলগুলোতে যে সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ তা সামনেও অব্যাহত থাকবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।





