হাসিনা, জয় ও পুতুলের কারাদণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ৯:২৩:২৩ অপরাহ্ন
সম্পদের প্রতি হাসিনার ‘এত লোভ’ : পর্যবেক্ষণে আদালত

জালালাবাদ রিপোর্ট : ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে করা তিন মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, কোনো আবেদনপত্র ছাড়াই এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের নামে প্লট বরাদ্দ করা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেছেন। এ রায়কে ঘিরে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশ, বিজিবিসহ ব্যাপক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের পর এবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় দ্বিতীয় রায় হলো। তবে শেখ হাসিনা, তার ছেলে ও মেয়ে সকলে পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতেই এই মামলার বিচার হয়েছে।
এ মামলার ২৩ জন আসামির মধ্যে কেবলমাত্র রাজউকের একজন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম কারাগারে রয়েছেন।মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে আত্মসর্মপণ করেন তিনি। আসামি এস আলমের এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ২৩ জনের মধ্যে এই একজন আসামিই শুধু কারাগারে রয়েছেন। রায়ের দিন সকালে বৃহস্পতিবার তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
আসামিদের যে সাজা দিয়েছে আদালত :তিন মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৩ আসামির মধ্যে সাজা পেয়েছেন ২১ জন। বাকি একজনকে আগেই চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।এ মামলার আরেক আসামি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকারকে তিন মামলা থেকেই খালাস করে রায় দিয়েছে আদালত।
রায়ের পরে এক ব্রিফিংয়ে দুদকের আইনজীবী মইনুল হাসান জানান, শেখ হাসিনা তিন মামলাতেই আসামি।সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয় পৃথক দুই মামলার আসামি। অন্য আসামিরা তিন মামলাতেই রয়েছেন।
মইনুল হাসান বলেন, “আদালত বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন আসামিদের সাজা প্রদান করেছেন। এই তিনটি মামলায় যারা কমন আসামি আছেন, আমি একত্রে তাদের সাজা জানাচ্ছি।শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন মামলায় মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এই মামলার প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। তিন মামলাতেই উনি আসামি হিসেবে আছেন। উনার সাজা হচ্ছে সাত বছর করে ২১ বছর। উনার জরিমানা হচ্ছে এক লাখ করে তিন লাখ টাকা। অনাদায়ে ছয় মাস করে তিন মামলায় ১৮ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল যে মামলার প্রধান আসামি তার সাজা পাঁচ বছর। উনি একটি মামলারই আসামি, তাই তার সাজা পাঁচ বছর। সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় যে মামলার প্রধান আসামি তার সাজার মেয়াদ পাঁচ বছর এবং এক লাখ টাকা জরিমানা, জানান মইনুল হাসান। তিন মামলায় সাজা হওয়া আসামিদের পৃথকভাবে তিন মামলাতেই সাজা খাটতে হবে বলে জানান দুদকের আইনজীবী।হাসান বলেন, এভাবে তিন মামলায় ২১ জন আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। যারা তিন মামলায় কমন আসামি রয়েছেন, তাদের ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে তিন মামলায় সাজা খাটবেন, আলাদা আলাদা সাজা খাটবেন।
সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে এক মামলায় ছয় বছর করে মোট ১৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকারকে তিন মামলায় মোট ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিন মামলায় ১৮ বছরের একই সাজা দেওয়া হয়েছে ওই মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন।রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান মিয়াকে তিন মামলাতেই মোট ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনকে তিন মামলাতে মোট নয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আরেক সাবেক কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার তিন মামলার আসামি। এক মামলায় এক বছর করে মোট তিন বছরের কারাদণ্ডের সাজা তাকে দিয়েছে আদালত।রাজউকের কর্মকর্তা খুরশিদ আলম তিন মামলারই আসামি। এক বছর করে মোট তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাকে।
এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এক মামলায় ছয় বছর করে দুই মামলায় তার মোট সাজা ১২ বছর।সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সাজা না হওয়ায় আপিল করবেন কি না এমন প্রশ্নে দুদকের আইনজীবী বলেন, সাজার বিষয়ে কমিশনের সাথে আলাপ আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন।
রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে :
শেখ হাসিনা একজন পলিটিক্যাল লিডার, চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তার কেন এতো টাকা লাগবে, এতো সম্পদ লাগবে? ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্লট দুর্নীতির তিন মামলায় বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন। বিস্মিত হয়ে তিনি এও বলেন, তার সম্পদের প্রতি এত লোভ!দুদকের আইনজীবী জানান, মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, সরকারি সম্পত্তি নিজের নামে নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন শেখ হাসিনা।
একইসাথে প্লট নেওয়ার জন্য যে হলফনামা দেওয়া হয়েছিল তাতে নোটারি করা ছিল না বিধায় সেই হলফনামা জাল নথি ছিল বলে রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত।একইসাথে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের বিধিমালা বা কোনো নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে আদালত।
রায়ের পরে ব্রিফিং এ দুদক আইনজীবী মইনুল হাসান বলেন, সেই পর্যবেক্ষণে উনি (বিচারক) উল্লেখ করেছেন যে, একজন দেশের প্রধানমন্ত্রী তথ্য গোপন করতে পারেন, মিথ্যা হলফনামা দিতে পারে এটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় নাই। তিনি অবাক হয়ে গেছেন। একটা দেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে মিথ্যা হলফনামা ও তথ্য গোপন করে জনগণের সম্পদ মিথ্যাভাবে নিয়ে নিয়েছেন!
রাজউক এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিষয়েও তাদের আইন পরিবর্তনের জন্য কিছু অবজারভেশন দিয়েছে আদালত।




