শিক্ষা সামগ্রীর দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে, ৭১ শতাংশ শিক্ষা ব্যয় বহন করে পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮:২৬:৫৬ অপরাহ্ন

জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশে গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে শিক্ষা সামগ্রীর দাম। শিক্ষা সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি করায় সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারের অভিভাবকরা। ফলে শিক্ষায় ঝরে পড়ার হারও বাড়ছে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
জাতিসংঘের সর্বশেষ ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হয় পরিবারকে। এনজিও বিদ্যালয়ের ফি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি, আর কিন্ডারগার্টেনে এ ব্যয় বাড়ে নয় গুণ পর্যন্ত। সেই সঙ্গে প্রাইভেট পড়ার খরচও বছর বছর বাড়ছে, যেখানে গ্রামাঞ্চলে এ ব্যয় ২০০০ সালের ২৮ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৪ শতাংশ, আর শহরে ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশে।
অভিভাবকেরা বলছেন, শিক্ষা উপকরণের পাশাপাশি বাড়ছে স্কুলের বেতন (টিউশন ফি), প্রাইভেট পড়ার ব্যয়সহ নানা খাতে ব্যয়। এসব খরচ বাড়ার তুলনায় তাদের আয়ে তেমন বাড়তি যোগ হয়নি। ফলে সন্তানদের পড়ার খরচ সামলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে। শিক্ষা খাতে ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের অধিকাংশ পরিবার, যা নতুন শিক্ষাবর্ষ সামনে রেখে আরও চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে অভিভাবকদের ওপর।
তথ্য বলছে, দেশের বাজারে ২০০৩ সালে কাগজের দিস্তার দাম শুরু হতো ৬ টাকায়। বর্তমানে সবচেয়ে নিম্নমানের কাগজের দিস্তাও ২০-২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আরেকটু ভালো মানের কাগজের দিস্তাপ্রতি দাম ছুঁয়েছে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। এ সময়ের ব্যবধানে কলম-পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স ও স্কুল ব্যাগের মতো অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে দুই-চার গুণ। যদিও সেই হিসেবে মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়েনি খুব বেশি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় না করায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো।
স্টেশনারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে পড়াশোনা সংক্রান্ত প্রায় সব উপকরণের দামই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ৩০০ পৃষ্ঠার একটি খাতার দাম এখন অন্তত ১৩০ টাকা, যা মানভেদে ১৭০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাত্র ৪-৫ বছর আগেও এই খাতা পাওয়া যেত ৯০ টাকায়। একইভাবে ২০০ পৃষ্ঠার খাতার দাম ৭০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১১৪ টাকায়। ১২০ পৃষ্ঠার খাতা আগে ৪০ টাকায় মিললেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকায়। খাতার পাশাপাশি বেড়েছে কলম, পেন্সিল ও অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রীর দামও। আগে যে বলপয়েন্ট কলমটি ৫ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটির দাম ১০ টাকা। পরীক্ষার বোর্ড, রাবার, শার্পনারসহ অন্যান্য সরঞ্জামের দামও একই হারে বাড়তি।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২০-২১ সালেও প্রতি দিস্তা কাগজের দাম ছিল ১৬ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। কাগজের এ অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রভাব সরাসরি পড়েছে বই, খাতা ও ব্যবহারিক খাতার দামে। তাদের ভাষায়, গত পাঁচ বছরে শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে গড়ে প্রায় শতভাগ।
স্টেশনারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন খাতা-কলমের বাজারটা একেবারে হাতের বাইরে চলে গেছে। আগে যে খাতার রিম ৯৫০-১০০০ টাকাছিল, সেটা এখন ১,৭০০ টাকার নিচে পাইকারি বাজারে পাওয়া যায় না। কলমের অবস্থাও একই, ১০ টাকার কলম এখন ১৮-২০ টাকা। এভাবে চললে পড়াশোনা সামগ্রী সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
স্টেশনারী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চীন থেকে আমদানি করা কলম, পেনসিল বক্স, প্লাস্টিক ফাইলসহ স্টেশনারি পণ্যের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। তবে এ পণ্যে আমদানিকারকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকায় দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। মাঝে কলমের দাম বাড়লেও পরে তা আবার আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। পেনসিলের দাম অবশ্য কিছুটা বেশি রয়েছে।
এদিকে, এমপিওভুক্ত ও ননএমপিও স্কুল কলেজের বেতন ছাড়া অন্যান্য সব ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নীতিমালা ২০২৪ অনুসারে মহানগরের এমপিওভুক্ত স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ২ হাজার ৪৬৫ টাকা পর্যন্ত ফি নেওয়া যাবে। জেলা সদর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরের এমপিওভুক্ত স্কুলের ক্ষেত্রে এ ফি ১ হাজার ৮৫০ টাকা, আর মফস্বলের ক্ষেত্রে ১ হাজার ৪০৫ টাকা। নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ব্যয় আরও বেশি। তবে অভিযোগ রয়েছে, সরকার নির্ধারিত এই ফি মানে না অধিকাংশ স্কুল কলেজ।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শুধু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য নয়, নিম্নবিত্তের জন্যও শিক্ষা নিশ্চিত করতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা সামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যালয়গুলোর অনিয়মে কোনো কার্যকর তদারকি নেই। ফলে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে।





