ঋণে সভরেন গ্যারান্টির অর্ধেকই বিদ্যুৎ খাতে!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুন ২০২৪, ৯:২৫:১৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : গত দেড় দশকে দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ১০০-এর বেশি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য নেয়া হয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ। এসব ঋণের জন্যও সরকার দিয়েছে সভরেন গ্যারান্টি। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতের ১৮টি প্রকল্পে রয়েছে সভরেন গ্যারান্টি, যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা; যা সরকারের মোট সভরেন গ্যারান্টির প্রায় ৪৬ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সংক্ষিপ্তসারে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে সরকারের সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৪ কোটি তিন লাখ টাকা; গত অর্থবছর যা ছিল ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর সরকারের মোট সভরেন গ্যারান্টির ৫২ দশমিক ২৩ শতাংশ ছিল বিদ্যুৎ খাতে।
বিদ্যুৎ খাতে মোট সভরেন গ্যারান্টির অর্ধেকের বেশি দেয়া হয়েছে দুটি প্রকল্পে। এর একটি হলো পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার জন্য সরকারের দেয়া গ্যারান্টির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার জন্য গ্যারান্টির পরিমাণ ১৬ হাজার ৮১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ দুই প্রকল্পেই সরকারের গ্যারান্টির পরিমাণ ৩৩ হাজার ২২৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছর সরকারের সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৯২ হাজার ৬০১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ওই বছর বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৪৯ হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা; যা মোট গ্যারান্টির ৫৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৭৩ হাজার ৮৩৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ছিল ৬০ হাজার ৬৫৩ কোটি সাত লাখ টাকা। ওই দুই অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল যথাক্রমে ৪১ হাজার ৬৯২ কোটি ২২ লাখ টাকা ও ৩৩ হাজার ৭৪১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে ওই দুই বছর বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল যথাক্রমে মোট গ্যারান্টির ৫৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৫৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এদিকে জ্বালানি তেল আমদানিকারক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিভিন্ন দেশ থেকে কঠিন শর্তের ঋণে তেল আমদানি করে থাকে। এজন্য সরকারকে সভরেন গ্যারান্টি দিতে হয়। বর্তমানে এর পরিমাণ সাত হাজার ৬৬০ কোটি টাকা, গত অর্থবছর যা ছিল চার হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছর বিপিসির জন্য সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বর্তমান সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ৬১ হাজার ২৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা; ২০১৯-২০ অর্থবছর যা ছিল ৩৪ হাজার ৯৪০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
অর্থ বিভাগের মতে, সরকার বিভিন্ন সময়ে সরকারি নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এসব ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে তার দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। তাই সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব রয়েছে। তবে সভরেন গ্যারান্টিজনিত আর্থিক ঝুঁকি কমাতে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করতে চাইছে সরকার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সভরেন গ্যারান্টি সরকারের আর্থিক ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি করে। আর বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাই বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের কাঁধেই এর দায় চাপবে। এছাড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তাই অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি তথা আর্থিক চাপ কমানো উচিত।
তথ্যমতে, অন্যান্য খাতের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) সভরেন গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। কৃষি খাতে এ গ্যারান্টির পরিমাণ তিন হাজার ৫৭৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের এক হাজার ৩৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং রাকাবের দুটি স্কিমের বিপরীতে গ্যারান্টি দুই হাজার ১৭৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়ে ঋণ বিতরণের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংককে চারটি স্কিমের বিপরীতে সভরেন গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে এক হাজার ৭৫০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এছাড়া পণ্য আমদানির জন্য টিসিবিকে দেয়া গ্যারান্টির পরিমাণ দুই হাজার ৪৩২ কোটি ১১ লাখ টাকা, আনসার ভিডিপি ব্যাংককে ৯০০ কোটি টাকা এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে ৮৭৮ কোটি টাকা। এছাড়া বিজেএমসিকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংগ্রহের জন্য ৯০ কোটি ৭০ লাখ টাকা গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এগুলো সবই দেশের অভ্যন্তরীণ দায়।
এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে উড়োজাহাজ এবং ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ কেনার জন্য দেয়া গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৩৯৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্পে ৭২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, পলাশ ঘোড়াশাল সার কারখানাকে ১০ হাজার ১১৩ কোটি টাকা, বিএডিসিকে সার আমদানির জন্য দেয়া গ্যারান্টি ১৮ হাজার ৯৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং বিসিআইসিকে সার আমদানির জন্য আট হাজার ৯৮৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।