তাকওয়ার শান দিতে এলো রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২১, ৬:২০:৫৮ অপরাহ্ন
জাফর আহমাদ
‘তাক্ওয়ার শান’ দিতে আবার এলো রমজান। মরিচা পরা বা অসুস্থ হয়ে পরা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য প্রতি বছরই এভাবে রমজান আসে। যেই তাক্ওয়া মানবতার সকল প্রকার কল্যাণ ও মর্যাদার প্রতীক। তাক্ওয়ার উপর ভিত্তি করেই নিরূপিত হয় মানুষের মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ তাকওয়ার উপর নির্ভরশীল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য তাকওয়ার কোন বিকল্প নেই। তাকওয়াহীন ব্যক্তি সে যেই হউন না কেন, তাকে সম্মানিত ব্যক্তি বলা যাবে না। যদিও পৃথিবীর মানুষ বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার ভিত্তিতে মর্যাদার বৃত্ত গড়ে তুলেছে, কিন্তু তাকওয়ার কাছে তা একান্তই মূল্যহীন। বংশ, ভাষা, বর্ণ ও দেশ এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি, তাই বলে এগুলো কোন মর্যাদার মানদন্ড বা মাপকাঠি নয়। বরং এগুলো আল্লাহ দিয়েছেন যাতে মানুষ পরস্পরকে চিনতে পারে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন ও খবর রাখেন।” (আল হুজরাত-১৩) অর্থাৎ যিনি সবচেয়ে বেশী মুত্তাকী তিনিই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত ও মর্যাদাবান।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর ন্যায় মুসলমানগণও যেদিন থেকে তাকওয়াকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মানুষের মর্যাদা দিতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে তাদের কপালও পুড়তে শুরু করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া ‘বুনিয়ানুম মারসুস’ ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’এর ফাটল বা ভাঙনও সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। বিজাতীয়দের ন্যায় মুসলমানদের মধ্যেও আজ খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠীগত বিভেদের পাহাড় পরিলক্ষিত হয়। আর এরই ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যেও অহংকার, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতন দানা বেধে উঠেছে। অথচ এটি ছিল ইহুদী-খ্রীষ্টান ও পৌত্তলিকদের চরিত্র। জাতীয়তার ভিত্তিতে ইহুদীরা মনে করেছে তারাই আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি। এজন্য পৃথিবীর সকল অইসরাঈলীরা অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টানেরা বলেছে ঈশা আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ), সুতরাং তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতি। হিন্দু জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠতর মনে করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যেও অসংখ্য কঠিন ভেদনীতি চালু করে রেখেছে। তারা বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শুদ্রদের লাঞ্ছনার গভীর খাদে নিক্ষেপ করেছে। তাদের ঘরে অন্যধর্মের কেউ ঢুকে পড়লে সেটিকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে থাকে। এরাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদার গণতন্ত্র ও কট্রর সমাজনীতি শ্রেণী সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েছে, সাদা-কালো বর্ণবাদনীতি অসংখ্য বণী আদমের রক্ত ঝরিয়েছে, আদিবাসী-অআদিবাসীর উচ্ছেদের সংগ্রাম তো চলছেই।
আমাদের ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন, বংশ, গোত্র ও গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তা এগুলো অহংকারেরও হোতা। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর সর্বপ্রথম যে গুনাহের খাতায় নাম লিখিয়েছিল সে হলো, শয়তান এবং প্রথম যে গুনাহটি আল্লাহর হুকুমকে মানতে অবাধ্য করেছিল সেটি হলো অহংকার। আর অহংকার সৃষ্টি হয়েছিল জন্মগত শ্রেষ্ঠত্বকে ভর করে। সুরা বাকারায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি ফিরিশতাদেরকে বলেছিলাম ঃ আদমকে সেজদা কর। সকলেই সেজদা করলো। কেবল ইবলিস করলো না। সে অস্বীকার ও অহংকার করলো। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।” অন্যত্র বলা হয়েছে ঃ সে বললো, আমি আগুনের তৈরী আর আদম মাটির তৈরী। অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহংকার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করলো এবং তাঁর লানত নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
কিন্তু ইসলাম এসব নীতিকে কখনোই সমর্থন করে না। মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ হলো, তাকওয়া। জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান। কেননা তাদের মুল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও নিয়ম-পদ্ধতি এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতামাতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সেটি দেখার বিষয় নয়। বরং যে মুল জিনিসের ভিত্তিতে একজন অপর জনের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে এই যে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহ ভীরু, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকী ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় কা’বা তাওয়াফের পর বক্তৃতা করেছিলেন তাতে তিনি বলেন ঃ “সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের দোষ-ত্রুটি ও অহংকার দূর করে দিয়েছেন। হে লোকেরা! সমস্ত মানুষ দু-ভাগে বিভক্ত। এক, নেক আমলদার ও পরহেযগার-যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদার অধিকারী। দুই, পাপী ও দুরাচার যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট। অন্যথায় সমস্ত মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির সৃষ্টি।” (তিরমিযি) অন্য এক হাদীসে উল্লেখ আছেঃ “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন।” (মুসলিম, ইবনে মাযাহ)
ইসলাম সাম্য-সংহতির অনুপম শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তি চরিত্রে নয়, বরং মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাস্তবায়ন করেছে। আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক সমাজ কায়েম করেছিলেন, যেখানে বর্ণ, বংশ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার কোন ভেদাভেদ ছিলনা, যেখানে উচ্চ নীচ, ছুত-ছাত এবং বিভেদ ও পক্ষপাতিত্বের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সে সমাজ ব্যবস্থায় হযরত বেলাল রা: এবং হযরত ওমর রা: এর মধ্যে যেমন কোন পার্থক্য ছিল না, তেমনি আলী রা: ও আনাস-যায়েদ ইবনে সাবেত রা: মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। থাকলেও সেটি তাকওয়ার ভিত্তিতেই নিরূপিত হতো। একবার হযরত ওমর রা: বেলালকে রা: ধমক দিয়ে কথা বললে রাসুল সা: অসন্তুষ্ট হন এবং বললেন, ওমর হে! তোমার কি এখনো বংশীয় গৌরব রয়েছে ? ওমর রা: লজ্জিত হলেন। তিনি নিজের সকল আভিজাত্যের অহংবোধকে ধ্বংস করে দেন। মানবিক সাম্য ও ঐক্য সে সমাজকে এমনি ফুলে-ফলে সুশোভিত করেছিল, যা পৃথিবীর আর কোন ধর্ম বা ব্যবস্থায় সামান্যতমও পরিলক্ষিত হয় না।
এ ভাবটিই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেনঃ
“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।
এক জনে দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান।”——-(কুলি-মজুর, সাম্যবাদী, নজরুল রচনাবলী)
প্রকৃতপক্ষে আমরা মুত্তাকী হতে পারছি না বিধায় ইহুদী-খ্রিষ্টানদের ন্যায় বিকল্প পথে মর্যাদার সন্ধান করে ফিরছি। আর এজন্য আমরাও বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার ভিত্তিতে মর্যাদার বৃত্ত গড়ে তুলেছি। এ নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যেই আমাদের সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এ নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে নিয়ে যেতে পারছি না বিধায় উন্নয়নের বাঁধাগুলোও টপকানো আমাদের জন্য দুষ্কর হয়েছে। ফলে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা ইহুদী- খ্রিষ্টানদের আজ্ঞাবহ সাজতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ তাকওয়ার মত মানবীয় উন্নতর গুণের অধিকারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণের ভান্ডার সংরক্ষিত রয়েছে বলে আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সত্যিই মুসলিম দেশসমুহের ভৌগলিক ও কৌশলগত অবস্থান অধিকতর এমন উত্তম স্থানে রয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিম দেশের মাটির নিচে আল্লাহ তা’আলা অফুরন্ত নিয়ামতের ভান্ডার মজুত করে রেখেছেন। আমাদের গোলামী ও পরাজিত মানসিকতার কারণে আল্লাহ দান করছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের বর্তমান মুসলিম দেশসমুহের সরকার প্রধানগণ আল্লাহর ভয়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী-খ্রীষ্টানগোষ্ঠীকেই বেশী ভয় করেন। এজন্যই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনতো ও তাক্ওয়া বা ভয় করতো তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকান্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।” (সুরা আরাফ-৯৬)
তাকওয়া এমন একটা শক্তি, এমন একটা গুণ, যার উপর ভিত্তি করে মানুষ হক ও বাতিল, ভুল ও সঠিক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যিনি শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে সেটিকেই সত্য হিসেবে মেনে নেন যা তিনি নাযিল করেছেন। তিনি সেটিকেই সঠিক মনে করেন, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যে কাজ বা প্রথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরো অসংখ্য ক্ষতির সৃষ্টি করে, যে সকল কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। এ ধরণের ক্ষতিকর কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই জরুরী। আত্মরক্ষার জন্য আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দরকার বাস্তব ট্রেনিং। পুরো রমজানে আমাদেরকে সেই বাস্তব ট্রেনিংই দিয়ে থাকে। রমজানের সিয়াম একমাস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আমাদেরকে মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
মনে রাখতে হবে, তাকওয়ার গুণ সম্পন্ন মর্যাদাশীল জনগোষ্টি নিয়ে যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেটিই হবে আল-কুরআনের সমাজ, ইসলামী সমাজ ও আল্লাহর পছন্দের সমাজ। এ সমাজের প্রতিটি লোক ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবেন। দেশের সকল সেক্টরে উন্নয়নের ফল্গুধারা প্রবলবেগে প্রবাহিত হবে। দেশ উন্নত হবে। দেশ সম্মানিত হবে।