উষ্ণায়নের চূড়ান্ত সিঁড়িতে পৃথিবী ; প্রতিকারে বিশ্ববাসীর দায়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুন ২০২৩, ৮:০৩:৩৯ অপরাহ্ন
ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী
উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বিশ্ব উষ্ণায়ন এখন পৃথিবী নামক গ্রহটির সবচেয়ে বিপদজনক প্রাকৃতিক অসুখ। সামপ্রতিক বছরগুলোতে মানুষ উষ্ণায়নের হুংকারের আঁচ তীব্রভাবে অনুভব করছে। বিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে এর উষ্ণতা কখনো বেড়েছে কখনো কমেছে, কিন্তু গত কয়েক দশক হতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। এই দশকে দ্রুত প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রকৃতিতে। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রা। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) বলেছে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগামী ৫ বছরে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রীর উপরে উঠে যেতে পারে যা অত্যন্ত ভয়াবহ সংবাদ এই ধরিত্রীর জন্য, বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি গভীর আশংকাজনক। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস স্পর্শ করলে জলবায়ুর অভিযোজন সম্ভব হবে না, পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহ চরম প্রাকৃতিক বৈরিতার মুখে পড়বে ফলে প্রাণ ধারন করাটাই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন জলবায়ুতে সামপ্রতিক বছরগুলোতে চলছে এল-নিনোর প্রভাব যার কারণে তাপমাত্রা কিছু বছর বেশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের শিল্পো উন্নোয়নের বিলাসিতা ও প্রতিযোগীতা। শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীন হাউস মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস। পৃথিবীতে বর্তমানে এদের বার্ষিক নির্গমন হার যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৯৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে নেচার কমিউনিকেশনস্ একটি গবেষণা নিবন্ধে বলেছে, দিন দিন উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা বাড়ার ফলে অতিবৃষ্টির হার বাড়ে ৭ ভাগ, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনের হার ব্যাপক বেড়ে যায়। পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে প্রতি দশকে দুই থেকে তিনবার ভয়ংকর অতিবৃষ্টির কবলে পড়বে পৃথিবী একবার প্রচন্ড খরায় জমি শুকিয়ে যাবে এবং মাটি চারবার উর্বরতা হারাবে। ফলে ৮০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়তে পারে এবং ২৯ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ সাল সময়কালে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়েছে। আবহাওয়া ও প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত ফলে কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি আবার কোথাও তীব্র শীত সহ তুষারপাত হচ্ছে। কিছু মরু এলাকায় শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক সবুজায়ন আবার কিছু সবুজ সজীব এলাকায় শুরু হয়েছে মরুকরণ। পানিতে সংক্রমন দেখা দিচ্ছে, জীবজন্তুর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠে ফলে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে উৎপাদিত গ্রীন হাউস গ্যাসের ৯০ ভাগ শোষণ করে সমুদ্র। স্টেট অব দ্যা গ্লোবাল ক্লাইমেট এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে সমুদ্রের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রের পৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সেটা নিম্নচাপ সৃষ্টি করে ফলে তৈরি হয় ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং ঘূর্ণিঝড়গুলো অনুকূল বাতাসে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে সেই শক্তি অনেকদিন ধরে রেখে তীব্রবেগে উপকূলে আঘাত হানে। যেমনটি সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মোখায় দেখা গেছে এটি অনেকদিন ধরে শক্তি ধরে রেখেছিলো এবং প্রায় ১৭৫ কি.মি. বেগে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের সীমানা উপকূল ঘেঁষে মিয়ানমারে আঘাত করেছিলো। ওয়েদার আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়েব সাইটের দেয়া তথ্যমতে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৫টি ঘূর্ণিঝড়েরর মধ্যে ২৬টিরই জন্ম বঙ্গপসাগরে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিট ওয়েভ বা তাপ প্রবাহের ঘটনা এর মধ্যেই বেড়েছে ২.৮ গুণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে তা ৯.৪ গুণ বাড়বে। ১৯৮০ সাল থকে ২০০৯ সাল এই ৩০ বছরে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে ১৪ দিন, কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৯ এই ১০ বছরে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৬ দিন। গত ৮ মে ঢাকার তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস উঠেছিলো এবং আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় তা প্রায় ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয়েছিলো। এ বছর পুরো এপ্রিল ও মে মাস সারাদেশে তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়। এই তাপদাহ পুরো এশিয়া জুড়ে চলছে। এ বছর ভিয়েতনামে ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রী এবং লাওসে ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রী এবং থাইল্যান্ডে ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস উঠেছে যা দেশগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছুয়েছে।
তীব্র তাপদাহের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রম ঘন্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৫ নম্বরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি শ্রম ঘন্টা। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স রিপোর্ট ২০১০ এর মতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১ম।
বিশ্বের উষ্ণায়ন রোধ এবং উষ্ণায়নের প্রভাব ঠেকানোর জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো এখনো নিত্য নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, কিন্তু কার্যকরী ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৯৭ সালের কিয়োর্টো প্রটোকলে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশকে ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেয়া হয় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটা হতে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় বাকি দেশগুলোও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়।
২১তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২০১০৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর বিশ্বের ১৯৬টি দেশ গ্রীন হাউস গ্যাস হ্রাস করার পদ্ধতির অংশ হিসেবে প্যারিসে চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। সেই চুক্তিতে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রথমে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে, পরবর্তীতে তা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রীতে রাখার জন্য নির্ধারণ করা হয়। সেই সাথে সিদ্ধান্ত হয় যে, ২০৫০-২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিন হাউস কমিয়ে আনা হবে সেই পর্যন্ত যে পর্যন্ত উদ্ভিদ, মাটি ও সমুদ্র শোষণ করতে পারে স্বাভাবিকভাবে। চুক্তিতে প্রতি ৫ বছর অন্তর গ্যাস নিঃসরণ রোধে প্রত্যেকটি দেশের ভূমিকা পর্যালোচনার এবং গরীব দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিল দিয়ে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে।
প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবে না দায়ী দেশগুলোর কাছে, সেটি সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। শুধু বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন রোধে বিভিন্ন প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা পাবার কথা বলা হয়েছে যার মূল্য ১০০ বিলিয়ন যা নিতান্ত কম। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য তীব্র হতাশাজনক। তাছাড়া এই অর্থ সহায়তা তহবিল কে দিবে সেই বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ নেই। এই চুক্তির ফলে উন্নত দেশগুলো তাদের ইচ্ছামতো কার্বন নিঃসরণের হার কমানো ও বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিজেরা নির্ধারণ করতে পারবে এবং বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো যে সব দেশ উন্নত নয় এবং বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণে দায়ীও নয় তাদেরকেও জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে এসেছে কৌশলে। ভবিষ্যতে যে সহায়তা তহবিলে অর্থ প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করবে না সেটা ভাবার কোন অবকাশ নেই।
আশার দিক হলো উষ্ণতা রোধে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আর সেটাতে বিশাল অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়ে হাজির হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের বিল গেটস। তিনি বিখ্যাত হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রজেক্ট Stratospheric Controller Perturbation Experiment (SCoPEx) অর্থ জোগান দিচ্ছেন। এটা এমন এক প্রযুক্তি যার সাহায্যে পৃথিবীতে এসে পড়া অতিরিক্ত সূর্য রশ্মিকে আবার মহাকাশেই ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে শীতল রাখা যাবে।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামানো না গেলে এবং শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধব নীতি ও কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ না করলে অরিচেই পুরো পৃথিবী অত্যন্ত বিপদজনক পরিস্থিতিতির মুখোমুখি হয়ে পড়বে যা খুবই দ্রুত পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলকে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য করবে।
লেখক : প্রভাষক ও পরিবেশ কর্মী।