করোনা-রোজা ও দ্রব্যমূল্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২১, ৭:৪৮:৩৯ অপরাহ্ন
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
করোনার প্রথম ধাক্কা সামাল দেয়ার আগেই দ্বিতীয় ধাক্কা এসেছে। মানুষ এখন করোনা আতংকে। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই লকডাউন চলছে। পৃথিবীতে মৃত্যু ৩০ লাখেরও বেশী। বাংলাদেশ সরকার নো মাস্ক নো সার্ভিস নীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ ও জেলা প্রশাসন করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে উদ্ধুদ্ধকরণ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের একবছর পার করেছে। সরকারের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ আয়োজন ও দেশের মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণে উর্ধ্বগতি লক্ষ্যে করা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের চরম আতংকের মধ্যে সারা বিশ্বের মুসলমান পবিত্র রমজান পালন করছে।
আমরা অনেকেই চিন্তা করেছিলাম করোনার টিকা আবিষ্কার হলে করোনা আমাদের থেকে পালিয়ে যাবে। আবার অনেকের ধারণা ছিল গরমের সময় করোনা থাকবেনা। সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছেন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহর ঘোষনা হলো ফায়ালুল্লিমা ইউরিদ। আল্লাহ্র ইচ্ছামতই সবকিছু হয়। করোনার ভয়াবহ থাবায় ও একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মনে আল্লাহর ভয় কাজ করেনি। মাহে রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য গুদামজাত করে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন এবং ক্রেতা সাধারণ উচ্চমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হন। যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন তারা কখনও চিন্তা করেননা সাধারণ ক্রেতার মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা একবেলা খেলে হয়তো আরেকবেলা না খেয়েই থাকতে হয়।
আর একটি জিনিস লক্ষনীয়, যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন তাদের কেউ কেউ নামাজি, দাঁড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা, ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর ঘোষণা হলো সৎকর্ম কেবল এটাই নয় যে, তোমার মুখমন্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে, কিন্তু পূণ্য আছে ঈমান আনলে, আল্লাহ পরকাল ফেরেশতা, কিতাব ও নবীদের প্রতি আর আল্লাহর মহব্বতে অর্থ খরচ করলে আত্মীয় স্বজন, এতিম, পথের কাঙ্গাল, ভিক্ষুক ও দাসমুক্তির জন্য আর নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে যাকাত দিলে ওয়াদা দিয়ে পালন করলে, এবং ধৈর্য্য ধারণ করলে অভাবে, দুঃখ কষ্টে ও যুদ্ধে এরাই সত্যপরায়ন এবং এরাই মুত্তাকী (সুরা বাকারাহ্ আয়াত ১৭৭)। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে কোন লাভ হবেনা। করোনা মহামারি আমাদের দেখিয়েছে কোটি কোটি টাকার মালিক ও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। করোনাকালে এবারের রোজা আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের গুনাহ্মাফের একটি অফুরন্ত সুযোগ।
সে সুযোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তওবা করতে হবে মৃত্যু আসার পূর্বেই। রোজা হলো গুনাহ্ মাফের কাফফ্রাহ্। তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহ্ভীতি অর্জন করা যায় রোজা রাখার মাধ্যমে। কুপ্রবৃত্তির ক্ষমতা দূর্বল হয় রোজা রাখার মাধ্যমে। ধৈর্র্য্য সবর ও দৃঢ় সংকল্প সৃষ্টির মাধ্যম হলো রোজা। রোজা আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া আদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টজীবের প্রতি সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় রোজা। রোজা অধঃস্থন মানুষ ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়।
রোযা মানুষের শারীরিক সুস্থতার ও কারণ। রোযার রয়েছে আধ্যাত্মিক কল্যাণ। রোযা রেখে আমরা সকাল প্রকার মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকব। আমরা অন্যের অধিকার হরণ করব না। কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হব না। ওজনে কম দেব না, ব্যবসায় কাউকে ঠকাবোনা, অধিক মূল্য রাখব না। সততা ও নিষ্টার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করব।
মহান আল্লাহর ঘোষণা আমি তোমাদের যা কিছু অর্থ সম্পদ দিয়েছি তা থেকে তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই। কেননা সামনে মৃত্যু এসে দাড়ালে সে বলবে, হে আমার মালিক তুমি যদি আমাকে আরো কিছু কালের অবকাশ দিতে তাহলে আমি তোমার পথে দান করতাম এবং আমি তোমার নেক বান্দাদের শামিল হয়ে যেতাম। কিন্তু কারো নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহতায়ালা তাকে এক মুহূর্তও অবকাশ দিবেন না। তোমরা দুনিয়ার জীবনে যা কিছু করছো আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন। (সূরা আল মোনাফেকুন আয়াত ১০-১১) আমাদের মহান প্রভূর ইচ্ছায় করোনা এসেছে এবং প্রেমময় প্রভূর ইচ্ছায় করোনা বিদায় নেবে।
তবে আমাদের সতর্ক হতে হবে করোনা নামক আল্লাহর গজবকে ভয় করতে হবে। বিশেষ করে রমজান মাসে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। পাশাপাশি সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ এ.বি.এম আব্দুল্লাহ বলেছেন ৪টি শর্ত মানলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। শারীরিক দূরত্ব কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি সর্বোতভাবে পালন করতে হবে। সবার করোনা টিকা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে ৪০ বছর বা তার বেশী বয়স যাদের তাদের অবশ্যই টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে প্রবল শিথিলতা ও অনীহা বিরাজমান। মানুষ মাস্ক পড়তেই চায়না, মাস্ক পড়া যেন একশ্রেণীর মানুষের কাছে অন্যায় কাজ মনে হয়। সিলেটের বিভিন্ন মসজিদে যখন নামাজ পড়তে গিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে এখনো অনেক মানুষ মাস্ক পড়ে না এ অবস্থা চলতে পারেনা, এঅবস্থা চলতে দেয়া যায়না। অথচ সিলেটে ভয়াবহভাবে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। প্রতিদিন শতাধিক আক্রান্ত হলেও কোথাও কেউ মানছেনা স্বাস্থ্যবিধি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সংক্রমণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
সরকারি নির্দেশনা মানতে মুসল্লিদের বাধ্য করতেও সচেতন করতে মসজিদ কমিটিকে কঠোর ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি। মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক সত্বেও বেশীরভাগ মানুষ মাস্ক পরছেননা। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ কঠোর করতে হবে। মানুষের বিবেক কাজ না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের মানুষ যদি মাস্ক পড়তে অভ্যস্থ হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে রাষ্ট্রকে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি দীর্ঘায়িত করতে হবেনা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য লকডাউন কোন স্থায়ী সমাধান নয়। লকডাউন দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। তাই লকডাউন দীর্ঘায়িত না করে সভা সমাবেশ, বই মেলা, উৎসব, সামাজিক আড্ডা বন্ধ করে দিতে হবে। লকডাউনের পরিণতি মানুষের জীবন জীবিকায় আঘাত আনবে। লকডাউন না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
গত বছর দীর্ঘ লকডাউন হয়েছে, তখন অনেক মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে দারিদ্রের হার ছিল ২০ শতাংশের মতো বর্তমানে সেটা বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়ে গেছে, সূত্র দৈনিক প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল ২০২১।
আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো মাসের পর মাস বাংলাদেশে লকডাউন দেয়া যাবেনা। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন লকডাউন থাকলে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে, আর অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে করোনার আক্রমণ করার আগেই অনেক মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে করোনা পৃথিবী থেকে সহজে বিদায় নেবে এমন লক্ষণ দেখা যায়না। সুতরাং আমাদের নিজের স্বার্থে পরিবারের স্বার্থে দেশ ও সমাজের স্বার্থে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অপরিহার্য। আজকের লেখাটি শেষ করার আগে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার এর জীবনের শেষ তিনটি ইচ্ছার কথা সকলের জন্য উপস্থাপন করছি। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট তার মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন, সেনাপতিরা যেন তার মৃত্যুর পর তার তিনটি শেষ ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করেন।
প্রথম ইচ্ছাঃ চিকিৎসকরাই একমাত্র আমার কফিন বহন করবেন। আমার চিকিৎসকদেরই কফিন বহন করতে বলছি, “যাতে মানুষ বুঝেন চিকিৎসকরা ক্ষমতাহীন এবং মৃত্যুর হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম”।
দ্বিতীয় ইচ্ছাঃ “যে পথ দিয়ে আমার কফিন সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে সেই পথে আমার কোষাগারে থাকা সমস্ত সোনা রূপা ও মূল্যবান পাথর ছড়াতে ছড়াতে যেতে হবে”। পথে আমার সম্পদ ছড়াতে বললাম এজন্য মানুষ জানুক আমার সম্পদের একটি কণাও আমার সঙ্গে যাবেনা। এগুলির জন্য আমি সারজীবন সময় দিয়েছি। কিন্তু এখন কিছুই নিয়ে যেতে পারছিনা। ধন সম্পদের পিছনে ছোটা সময়ের অবচয় মাত্র।
তৃতীয় ইচ্ছাঃ কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হবে। “আমি এই পৃথিবীতে খালি হাতে এসেছিলাম, খালি হাতেই চলে যাচ্ছি। এটা মানুষকে বোঝাতেই আমি কফিনের বাইরে আমার হাত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছি”।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিষ্ট