কুরআন নাজিলের মাস রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২১, ১০:০৮:১০ অপরাহ্ন
জাফর আহমাদ
রমজান মাস মানে কুরআনের মাস। রমজান এলেই মনে পড়ে আল্লাহ রাহমানুর রাহিম দয়া করে মানব জাতির পথের দিশা এবং মুক্তির সঠিক পথ ও বাতিল পথের পার্থক্য নিরুপণের জন্য আল কুরআনের মত একটি নিয়ামত দান করেছেন। “রমজানতো সে মাস যাতে এ কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা-১৮৫)
আমরা প্রতিদিন সুরাতুল ফাতেহায় আবেদন করছি “(হে আল্লাহ) তুমি আমাদেরকে সরল সঠিক পথের দিশা দাও।” (সুরা ফাতেহা-৫) এরই ফলস্বরূপ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, “আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল-কুরআন) তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই, ইহা মুত্তাকী লোকদের পথ দেখাবে।” (সুরা বাকারা ১-২) অপর দিকে রমাদানের রোযা ফরজ করে আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের উপর। আশা করা যায় তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হবে।” (সুরা বাকারা-১৮৩)
উপরে উল্লেখিত দু’টো আয়াতে আল কুরআন ও রমাজানের রোজার মধ্যে একটি সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। রোজা মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করবে, আর আল কুরআন এ ধরণের তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী লোকদের অন্ধকারে নিশ্চিন্তে পথ চলার শক্তি ও আলো যোগাবে।
রমজানেই কুরআন নাজিল করা হয়েছে। তাহলে আমরা বলতে পারি আল কুরআনের কাজ হলো প্রাথমিকভাবে সৈন্যবাহিনীতে লোক নিয়োগ দান করে রমজানের রোজার হাতে ছেড়ে দেবে এবং রমজানের রোজা একটি মাস একে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা তথা দক্ষ সৈনিকে রূপান্তর বা তৈরি করে আবার কুরআনের হাতে সোপর্দ করবে। এবার আল কুরআন তাকে সামনে পথ চলার কর্মসূচী বাতলে দেবে। কুরআন তাকে বলে দেবে কোনটি জান্নাতের পথ আর কোনটি তাগুতের পথ। যেমন আল কুরআনের ঘোষণা “আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।”(সুরা বাকারা-১৮৫)
পুরো রমজান মাসে জাঁকজমকের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন এবং রোজার গুণাগুণ ও মহিমা বর্ণনা করা হবে। কিন্তু যার কারণে রমজান এত মর্যাদা পেল সে মধ্যমনি আল কুরআনের কথা ভুলে যাওয়া হয়। রমজানতো ফরজ করা হয়েছে আল কুরআনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করার ট্রেনিং হিসেবে। শুধু রমজান নয় এমনিভাবে আমরা যতগুলো ইবাদাত পালন করে থাকি যেমন নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ, প্রতিটি ইবাদাতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো, সেই একটিই আর তা হলো, আল-কুরআন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদর্শ সৈনিকে পরিণত করা। কিন্তু আমরা এ মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে স্রেফ একটি অনুষ্ঠানে পরিণত করেছি। এভাবে লক্ষ্যহীন রোজা ও অন্যান্য ইবাদাত আমরা জীবনভর পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু ইবাদাতগুলোর ফায়দা পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন সালাত খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা, যাকাত পবিত্রতা দান করা এবং রোজা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছেনা। আর প্রতিটি ইবাদাত যেহেতু দক্ষ সৈনিকে প্রস্তুত করতে পারেনি তাই কুরআনও আমাদের পথ দেখাতে পারছে না। এমনিভাবে আমরা যারা রমজানের রোজাকে আল কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি এবং আল কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে, মানতে এবং সে অনুযায়ী জীবন গঠন করতে চাই না। তাই রোজা ও আল কুরআন যৌথভাবে আমাদের তাকওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারছে না। অথচ তাকওয়া এমন একটা জিনিস, এমন একটা শক্তি, যার উপর ভিত্তি করে মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে, ন্যায় কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারে। নিজের ক্ষতি হবে, এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তাকওয়া।
কিন্তু মানুষের যদি এ জ্ঞানই না থাকে যে, কিসে তার ক্ষতি কিসে তার ভালো, তবে সে কীভাবে বিরত থাকবে? কুরআন হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী একটি কষ্টিপাথর, যা আল্লাহ নাজিল করেছেন “রমজানতো সে মাস যাতে এ কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা-১৮৫)
সুতরাং রমজান মাস থেকে পুরোপুরি ফায়দা হাসিল করার জন্য সর্বপ্রথম রমজানের গুরুত্ব, বরকত এবং মর্যাদা সম্পর্কে আমাদের অবহিত হতে হবে। এ পবিত্র মাসে আমরা যা কিছু ইবাদাত এবং কর্মকান্ডে লিপ্ত হই, এসব কিছুর মাধ্যমে আমাদের মধ্যে তাকওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। যে তাকওয়া আমাদের আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান এবং কুরআনের মিশনকে পরিপূর্ণ করার যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। সেজন্য কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ পূবেই বলা হয়েছে যে, এ পবিত্র মাসের রোজাসহ সব কিছুই কুরআনের সাথে কেন্দ্রীভূত করে দেয়া হয়েছে। এ মাসের অধিকাংশ সময় আমাদের কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তা বুঝে পড়ার চেষ্টা করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ কুরআনের প্রতি এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কুরআনই একমাত্র ব্যক্তি, সমাজ, যুগ পাল্টে দিতে সক্ষম। এবং কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যার স্পর্শে যে কোন ব্যক্তি, সমাজ ও যুগ পরিবর্তন হতে বাধ্য। যেমন:-
সোনালী সমাজ বিনির্মাণ: পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায় হল জাহেলিয়াত, পাশবিকতা ও হিংস্রতা, শিরক ও পৌত্তলিকতা ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-কুরআন এর বদৌলতে একে পাল্টে সোনালী যুগ বিনির্মাণ করেছিলেন। যে যুগ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলছেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ হল আমার যুগ।”
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা বৃদ্ধি: এ কুরআনের কারণে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্মানিত হয়েছেন। কারণ তিনি প্রথম নিজের স্কন্ধে এর গুরুভার দায়িত্ব নেন। “আমি আকাশ পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এ আমানত (আল-কুরআন তথা খেলাফতের দায়িত্ব) পেশ করলাম। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হল না, তারা ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মানুষ তার স্কন্ধে তুলে নিল।” (সুরা আহযাব-৭২) “ইয়াসিন। (এই) জ্ঞানগর্ভ কুরআনের শপথ, তুমি অবশ্যই রাসুলদের একজন, নিঃসন্দেহে তুমি সরল পথের উপর (প্রতিষ্ঠিত) রয়েছো। পরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকেই এই (কুরআন) অবতরণ।” (সুরা ইয়াসিন ১-৫)
সোনার মানুষ গঠন: ব্যক্তি ওমর সমুদ্রের সাইক্লোন সম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আল্লাহর নবীকে হত্যার জন্য ঝড়ের বেগে যাচ্ছিলেন, আল কুরআন সে ঝড়কে মাঝপথে থামিয়ে দিলো। অর্ধেকটা পৃথিবীর শাসনভার কুরআন তাঁর হাতে তুলে দিলো। আর এ কুরআন তাকে কোথায় নিয়ে গেলো যে, আল্লাহর নবী সার্টিফাই করছেন এভাবে “আমার পরে যদি কোন নবী আসতো তবে সে হতো ওমর। শুধু কি তাই আল কুরআনের এক নাম “ফোরকান” (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) আর হজরত ওমর রা: উপাধী হলো “ফারুক” (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।
মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি: রমজান মাস এত মর্যাদাবান হলো আল-কুরআন অবতীর্ণের কারণে। “রমজান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাজিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক ও বাতিলের) পার্থক্যকারী।” (সুরা বাকারা-১৮৫)
রাত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি: যে রাত্রিতে কুরআন নাজিল হলো, সে রাত্রি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “এ মর্যাদাপূর্ণ রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সুরা ক্বদর-৩) তাও আল কুরআনের কারণেই। অতএব, রমজানমাস মানে কুরআনের মাস। এ মাসে আল কুরআনের উৎসব শুরু হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রত্যেককে অত্যন্ত তাৎপর্যের সাথে এ উৎসব উপভোগ করার তৌফিক দিন।