বিজেপি’র রাজনীতি এবং বাংলাদেশের উদ্বেগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ এপ্রিল ২০২১, ৪:৪৭:২৬ অপরাহ্ন
আবদুর রহমান খান
মহামারি করোনার কবলে পড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রতিদিনই মৃত্যু আর সংক্রমণের বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে চলছে। সবচেয়ে বেশী সংক্রমণ চলছে উত্তর প্রদেশ এবং বাংলাদেশের লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ (বাংলা) রাজ্যে।
গত তিনদিন যাবত দৈনিক সংক্রমের সংখ্যা তিন লাখের ওপরে যাচ্ছে। শুক্রবার ২৩ এপ্রিল একদিনে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৩০ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। আর একদিনে মৃত্যু হয়েছে ২,২৬৩ জনের।
ভারতে ডাবল মিউটেশনের পর এবার ট্রিপল মিউটেশনের করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। এটি আগের চেয়ে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, নয়াদিল্লি ও বেশ কয়েকটি নমুনায় এ বিশেষ ধরণ শনাক্ত হয়েছে।
ভারতের সরকারি সূত্রে প্রকাশ, দেশটিতে এ যাবত ( ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ) ১লক্ষ ৮৯,৫৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১কোটি ৬৬লক্ষ ১০,৪৮১। হাসপাতাল অথবা হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন থাকা রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অক্সিজেনের তীব্র সংকট সামাল দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশটির উচ্চ আদালত। অক্সিজেন সংকট প্রসঙ্গে আদালত প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম ভাঙছে না কেন? কেন্দ্রীয় সরকার মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে কীভাবে এতটা অজ্ঞ হয়?
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পূর্ণ ব্যর্থতার ফলে কোভিড পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে । ২১ এপ্রিল দক্ষিণ দিনাজপুরের এক জনসভায় মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, “এটা গভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার ডিজাস্টার , মোদী মেড ডিজাস্টার , দেশে ইনজেকশন নেই, অক্সিজেন নেই”
অপর এক জনসভায় মমতা বলেছেন, ‘বিজেপি বাংলা দখল করার নাম করে বাংলাকেও আজ কোভিড সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে এবং সারাদেশকে সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে এ রাজ্য দু’জন প্রার্থী করোনায় মারা গেছেন, সংক্রমণের সংখ্যা দৈনিক এগার হাজার ছুঁয়েছে ।
এরকম ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে চলছে বিধান সভার হাই ভোল্টেজ নির্বাচন। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে কয়েকটি রাজ্যে এ নির্বাচন বন্ধ রাখা হলেও পশ্চিমবঙ্গে চলছে নির্বাচনী কুরুক্ষেত্র ।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে টেনে আনা হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। রাজ্যের ক্ষমাতাসীন মুখ্যামন্ত্রী মমতাকে হারিয়ে দেবার লক্ষ্য নিয়ে তাকে “বেগম জিয়া” বলে আক্রমণ করা হচ্ছে, মমতার মুসলিম তোষণের নীতির কারণে তাকে “মমতাজ বেগম” সম্বোধন করা হচ্ছে।
এদিকে, পুর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ থেকে উদবাস্তু হয়ে ভারতে বসবাসরত হিন্দুদের মাথার উপরে নাগরিকত্ব আইনের খড়গ ঝুলিয়ে আতংকের মধ্যে রাখার পাশাপাশি তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য সক্রিয় হয়েছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে গদিনসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি করোনা পরিস্থিতির মাঝেও বাংলাদেশে সফরে এসে সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জের দুটি মন্দিরে পূজা দিয়েছেন এবং হিন্দু নেতাদের সাথে বৈঠক করে গেছেন।
তবে, পশিম বাংলার নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের মানুষদের নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলেছেন তা বেশ উদ্বেগজনক । তিনি একবার বলেছেন, “অবৈধ অধিবাসীদের” বাংলাদেশে ফেরত পাঠান হবে। আর একবার বলেছেন “এদের বঙ্গোপসাগর ফেলে দেওয়া হবে” । আরো বলেছেন বিজেপি রাজ্যের সক্ষমতা পেলে “সীমান্ত পেরিয়ে একটা কাক-পক্ষীও বাংলায় (পশিমবঙ্গে) ঢুকতে পারবে না”।
ভারতের প্রতি অগাধ ভালবাসায় আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশের সরকার অবশ্য এতদিন এসব কথায় তেমন আমল দেয়নি। এমনকী , ভারতের নাগরিকত্ব আইন বা কাশ্মীরের মুসলমানদের ওপর পরিচালিত বর্বর নির্যাতনকেও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে চলেছে।
দিন দশেক আগে (১৩) ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহ কলকাতার বাংলা দৈনিক আন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার গরীব লোকেরা ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না বলেই ভারতে অনুপ্রবেশ করছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে।
সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় সমস্যা অনুপ্রবেশ। এটি ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী একটি রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থের কারণে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরে তৃণমূল অনুপ্রবেশকে মদত দিয়েছে, তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিরোধ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা শুধু রাজ্যের নয়, গোটা দেশের জন্য চিন্তার কারণ। এভাবে চললে আগামী ১০ বছর পর কলকাতার নাগরিকও অনুপ্রবেশ থেকে বাঁচতে পারবে না।
অবশেষে দু’দিন পরে , বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে অমিতশাহের জ্ঞান সীমিত। আমাদের দেশে এখন কেউ না খেয়ে মরে না। এখানে কোনো মঙ্গাও নেই। বেশ সাহস করেই ঢাকায় সাংবাদিকের কাছে ড. মোমেন বলেছেন, পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী লোক আছেন, দেখেও দেখেন না, জেনেও জানেন না। তবে তিনি (অমিত শাহ) যদি সেটা বলে থাকেন, আমি বলবো, বাংলাদেশ নিয়ে তার জ্ঞান সীমিত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, অমিত শাহ তার দেশকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলছেন এমনটি ভাবতে পারেন, কিন্তু বাস্বতবতা হচ্ছে ২০২০ সালে বিশ্বের ক্ষুধার্থ দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান ১০৭ টি দেশের মধ্যে ৯৪তম আর বাংলাদেশের অবস্থান বিশ ধাপ ওপরে ৭৫ তম ।
ভারতের পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডে ২০২০ সালের ১৯ম অক্টোবর সংখ্যায় লিখেছে, আনবিক বোমার অধিকারী একটি বৃহৎ দেশ ভারতে প্রতিদিন ১৯ কোটি মানুষ না খেয়েই রাতে ঘুমাতে যায়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক দিকে এগিয়ে রয়েছে। যেমন, ভারতের লোকদের ৫০ শতাংশের কোনো ভালো শৌচাগার নেই। আর আমাদের ৯০ শতাংশ লোকই স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করেন। আমার দেশের শিক্ষিত লোকের চাকরির অভাব আছে, তবে অশিক্ষিত লোকের কাজের অভাব নেই। ভারতের লক্ষাধিক মানুষ বাংলাদেশে চাকরি করে। তাই আমাদের ভারতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
অনেকদিন পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে এমন একটি জবাব শুনে দেশের জনগণ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাহসের প্রশংসা করার সুযোগ পেয়েছে। আর এ খবরটি ভারতে সহ বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয় ।
তবে, আবদুল মোমেন অবশ্য তার বক্তব্যের ঝাঁজ একটু নরম করে বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের গভীর সুসম্পর্কের আলোকে অমিত শাহের এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্যা নয়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বলেছেন, অমিত শাহের প্রায়শই উচ্চারিত এ জাতীয় বেফাঁস মন্তব্য বন্ধ করা নাহলে বাংলাদেশের প্রতি মোদিজীর আন্তরকিতা ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে।