করোনা কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়েছে ভারত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ এপ্রিল ২০২১, ৮:২৪:০৯ অপরাহ্ন
আবদুর রহমান খান
ভারতের করোনা সংক্রমণের অবনতিশীল পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ট্রেডোস আধানোম ঘেব্রিয়েসাস বলেছেন, ভারতের করোনা পরিস্থিতি খুবই সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে বলা হয়ে থাকে হৃদয়বিদারক। কিন্তু ভারতের পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ।
এদিকে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনের উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে মঙ্গলবার বিকেলে। বৈঠকে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল।
বৈঠকে করোনার টিকাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর মজুত গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হয়েছে ছয়টি দেশ। এছাড়াও কোভিড পরবর্তী দারিদ্রতা দূরীকরণে একসঙ্গে কাজ করবে দেশগুলো। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানান, নতুন এই উদ্যোগে ভারতকেও যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। এদিকে, ভারত থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ না পেয়ে বাংলাদেশকে এখন আফসোস করতে হচ্ছে।
তবে নিজ দেশের প্রয়োজনের যে যুক্তি দেখিয়ে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করেছে সেটা এখন তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ভারতের এমন অবন্ধুসূলভ আচরণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অসন্তোষ ব্যক্ত করে বসে নেই। বাংলাদেশ এখন টিকা পেতে চীনের নেতৃত্বে পাকিস্তান নেপালের সাথে জোট বেধেছে । এটা হতে পারে ভারতের জন্য গাত্রদাহের নতুন কারণ।
পাকিস্তানের সাহায্য প্রস্তাবে মোদির অসম্মতি: এদিকে, ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতির জেরে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী পাকিস্তানও জরুরী। পরিষেবা দিয়ে সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরইমধ্যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এ নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছে পাঞ্জাব কংগ্রেস।
সোমবার পাঞ্জাবের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুনীল জাখর অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তান অক্সিজেন রফতানি করতে চাইলেও কেন্দ্রের অসহযোগিতার জন্য সেটি পাচ্ছে না পাঞ্জাব।
তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের ভারী শিল্পগুলো যথেষ্ট অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং পাকিস্তান থেকে আমদানি করতেও রাজী। কিন্তু মাঝখানে চলে আসছে কেন্দ্রীয় সরকার।
সোমবার রাজ্য সরকারের বিশেষ কেবিনেট বৈঠকে মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় তোলেন সুনীল জাখর । তিনি হুঁশিয়ারি দেন, অক্সিজেনের অভাবে রাজ্যে একজনেরও মৃত্যু হলে কেন্দ্র তার জন্য দায়ী থাকবে।
তিনি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। সুনীল জাখর বলেন, যদি এই অক্সিজেন আমরা আমদানি করি, তাহলে রাজ্য সরকারই এর খরচ বহন করবে। রাজ্যের মানুষের জন্য এই অক্সিজেন অত্যন্ত জরুরী।
এদিকে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, অমৃতসরের এমপি এবং কংগ্রেস নেতা গুরজিৎ সিং আউজলা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে আর্জি জানিয়েছেন, একটি বিশেষ করিডোর তৈরি করে যেন পাকিস্তান থেকে অক্সিজেন আনার ব্যবস্থা করে কেন্দ্রীয় সরকার।
তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান সরকার এবং সেখানকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইধি ফাউন্ডেশন ভারতকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। সেই প্রস্তাব মুক্তহস্তে গ্রহণ করা উচিত।
কাঁচামাল রপ্তানি স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র: অন্যদিকে, ভারতে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল রপ্তানি স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগে নিজ দেশের মানুষকে টিকার জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এবার সেই একই যুক্তি দেখিয়ে দেশটিতে কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বদলাতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারত।
কিন্তু এক্ষেত্রে যেন ভারতীয়দের সুরেই জবাব দিচ্ছে মার্কিনিরা। ভারতের মতো তারাও বলছে, আগে নিজের চাহিদা, তারপর অন্যের। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়েছে ভারতের টিকা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ।
শনিবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর টিকার কাঁচামাল পাঠানোর বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা করেছেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাও চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তিনি কথা বলেছেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যানের সঙ্গেও। ওয়াশিংটন সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি বলছে, মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কয়েকজনও টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সমর্থন দিয়েছেন। তবে এটি পরিষ্কার যে, সেই প্রক্রিয়া এত সহজে সমাধান হবে না।
ভারতকে ফার্মা খাতে সহযোগিতা কমানোর ইঙ্গিত জার্মানীর: এদিকে, টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় ভারতকে ফার্মা খাতে সহযোগিতা কমিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল। তার উদ্ধৃতি দিয়ে পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারিতে জরুরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য আমাদের কাছে আসবে কি না তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, অবশ্যই ইউরোপের পক্ষ থেকে আমরা ভারতকে এত বড় ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদক হতে দিয়েছি এই আশাতে যে, তারা সেই অনুসারে চলবে। কিন্তু এখন যদি সেটি না হয়, তাহলে বিষয়টি আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
টিকা রফতানি বন্ধে ক্ষুব্ধ আফ্রিকা: ভারতের টিকা রফতানি বন্ধের প্রতিবাদে সরব হয়েছে আফ্রিকাও। গত বৃহস্পতিবার আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরিচালক জন নেকেনগাসং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ভারত যেন কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় আফ্রিকায় টিকা রফতানি বন্ধ না করে।
তিনি বলেন, আপনারা যদি আফ্রিকা বা বিশ্বের অন্য অংশগুলোর আগে নিজেদের টিকা দেয়ার কর্মসূচী সমাপ্ত করেন, তাহলে সেটি নিজেদের প্রতি সুবিচার হবে না। কারণ তাতে আফ্রিকায় করোনার ধরণ উদ্ভব হবে ও আপনাদের টিকাদান প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
করোনা মহামারির মারাত্মক ভয়াবহতা সত্ত্বেও আফ্রিকার অনেক দেশ এখনও টিকাদান কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি। আর যারা শুরু করেছিল, তারা দ্বিতীয় ডোজ কবে নাগাদ পাবে তা সেটিও নিশ্চিত নয়।
দায়ী নরেন্দ্র মোদির ভ্রান্ত নীতি: এদিকে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় শুক্রবারের এক সম্পাদকীয়তে ভারতে করোনা সংক্রমণের এ ভয়াবহতার জন্য নরেন্দ্র মোদির ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করা হয়েছে।
বৃটিশ পত্রিকাটি লিখেছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগমে হিন্দুদের কুম্ভমেলা এবং গণ-স্নানের আয়োজন এবং বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল মারত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি মোদী নিজে মাস্ক ছাড়া হাজার হাজার লোকের জনসমাবেশে বক্তৃতা করে অবস্থার অবনতি ঘটাতে ভূমিকা রেখেছেন।
পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় গতসপ্তাহে দক্ষিণ দিনাজপুরের নির্বাচনী জনসভায় বলেছেন, ভারতে ভয়াবহ করোনা সংক্রমণ এটা “গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া মেইড ডিজাস্টার, এটা মোদী-মেইড ডিজাস্টার”।