রমজান ও আল্লাহর পথে দান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২১, ৮:১৭:৫৬ অপরাহ্ন
জাফর আহমাদ
বুখারী শরীফে ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাপেক্ষা বেশি দানশীল ছিলেন। তাঁর দানের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি হতো রমজানে যখন জিবরাইল আমিনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হতো। জিবরাঈল আ: রমজানের প্রতি রাতে তাঁর সাথে দেখা করে কুরআনের সবক দিতেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণ বন্টনে প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল তখন তাঁর দানের কোন সীমা-পরিসীমা থাকতো না।” (বুখারী:৩৫৫৪, আ. প্র: ৩২৯০, ই.ফা: ৩২৯৯, কিতাবুল মানাকিব, বাবু সিফাতিন নাবী) অন্য হাদীসে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত আছে, “প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশগুণ।”(বুখারী: ১৮৯৪) সুতরাং দানের জন্য এর চেয়ে উত্তম মৌসুম আর কোনটি হতে পারে? অর্থ্যাৎ এ মাসে যতবেশি মাল আল্লাহর পথে, আল্লাহর দীনের পথে, নিজেদের আত্মীয় স্বজনের জন্য, গরীব দুঃখী, এতিম ও অসহায় মানবতার জন্য খরচ করা করা হবে, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ততবেশি বরং আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তার দুনিয়া ও আখিরাতকে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী করা হবে।
আল-কুরআন ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহর পথে একটি পয়সা, একটি শস্য, একটি দানের বিনিময়ে কমপক্ষে সাতশত গুণ প্রতিদান দেয়া হবে। এরপর বলা হয়েছে যেহেতু একটি ফরজ ৭০টি ফরজে বৃদ্ধি রমজানের বৈশিষ্ট্য তাই জাকাত আদায়ের উত্তম মৌসুম হলো রমজান। তাছাড়া এটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে, রমজান সমাপ্তির পর পরই আসে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে খুশির ঈদ। এই ঈদকে ধনী-গরিব সকল মুসলমানের ঘরে পৌঁছে দেয়ার জাকাত বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ মাসে জাকাতের স¤পূর্ণ টাকা আদায় করার জন্য বিশেষ তাগিদও করা হয়েছে। কেননা রমজানে আদায়কৃত জাকাতের প্রতিদান বহুগুণ বেশী পাওয়া যায়। হযরত ইবনে আব্বাস রা: রমজানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন।
আল কুরআনে নামাজের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত। কুরআন মাজীদে নামাজের মতো প্রায় সমান সংখ্যক আয়াতে জাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত আমরা নামাজের পরই রোজার কথা উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু আল কুরআন থেকে জানা যায় যে, নামাজের পর জাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ। এমনকি বলা হয়েছে যে, কাফির ও মুশরিকগণ যদিও তওবা করে ও ঈমান আনে, তথাপি যতক্ষণ না নামাজ আদায় করে এবং জাকাত না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হিসেবে গণ্য হবে না বরং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থ্যাৎ তাওবা এবং ঈমানকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য অবশ্যই তাদেরকে নামায আদায় ও জাকাত প্রদান করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হিসেবে গণ্য হবে।” (সুরা তাওবা-১১)
এখানে একজন ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভূক্তির জন্য ৪টি শর্ত মানতে হবে। প্রথমত: কুফর ও শিরক থেকে স¤পূর্ণভাবে খুলুছিয়াতের সহিত ফিরে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত: ট্রেডিশনাল ঈমান নয় বরং খাঁটিভাবে ঈমান আনতে হবে। তৃতীয়ত: ঈমান গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশের সাথে সাথে সালাতের যে ওয়াক্তটিই সামনে আসবে তা বাধ্যতামূলক আদায় ও কায়েমের ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত: মালের মালিক হলে বাধ্যতামূলক যাকাত আদায় করতে হবে ও যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, যাকাত কোন অনুদানের নাম নয়। বরং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রধান উৎস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমাজের কিছু লোককে তার সাংবাৎসরিক প্রয়োজন পূরণ করা ছাড়াও অতিরিক্ত সম্পদ দান করেন এবং কিছু লোককে প্রয়োজনের চেয়ে কম দিয়ে থাকেন। ইসলামী রাষ্ট্র এ দুয়ের সমন্বয় সাধনের জন্য সূদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির কোন বিকল্প নাই। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির জন্য রমজানের রোযা এক কার্যকরী হাতিয়ার।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা আমাদের শানিত ও শক্তিশালী তিনটি হাতিয়ার যথা: খাদ্য, যৌন ও পরিশ্রমের পর বিশ্রাম প্রবৃত্তিকে ক্রমাগত একটি মাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা এমন এক শক্তিশালী তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করে থাকি, যার মাধ্যমে নিজের স¤পূর্ণ দেহমন এবং সময়কে প্রভুর জন্য সোপর্দ করে দেই। আমাদের উঠা-বসা, কথা বলা, প্রতিটি বিষয় নিজের প্রভুর বন্দেগীর জন্য ওয়াকফ করে দেই। এ ধরণের ব্যক্তির সমস্ত ধন-সম্পদ, এবং সমস্ত নিয়ামত তা শারীরিক হোক বা আত্মিক, অবশ্যই তিনি তা আল্লাহর পথে নিয়োগ করবেন। এ গুলোই হলো তাকওয়ার গুণাবলী। আল-কুরআনের শুরুতেই এ মুত্তাকীদের কয়েকটি গুণের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর অন্যতম গুণটি হলো, “আল্লাহ যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে খরচ করেন।”
আমরা রোজার মাধমে ক্ষুৎ-পিপাসার মাধ্যমে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি, তেমনিভাবে বিপুল খরচের মাধ্যমে আমাদের পকেটকেও কষ্ট দেয়া প্রয়োজন। অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে আমাদের খরচের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। “মালের রোজা” এর মাধ্যমে আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় অসংখ্য বণী আদম যারা আপনার তুলনায় আর্থিকভাবে অনেক নিচে অবস্থান করে, ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রয়োজনটুকুই পুরণ করতে পারে না, তাদের মধ্যে এবং আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। এভাবে রমজান সহানুভূতিশীল ভ্রাতৃত্বপূর্ণ দরদী সমাজ গঠন করে থাকে। সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের প্রবল টানে সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সমাজের অধিবাসীরা হয়ে উঠে একাধারে নৈতিক, কল্যাণকামী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব জ্ঞান-সম্পন্ন পরস্পরের বন্ধু। আল কুরআনের ঘোষণা “ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসুলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।” সুরা তাওবা-৭১)
ধর্মীয় উৎসাহ ও আল্লাহ ভীতি ছাড়া যাকাত অর্থহীন। তেমনিভাবে নিজেদের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি না হলে রমজানের রোজা অর্থহীন। নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাতের এ পারস্পরিক গুরুত্বের ফলেই ইসলামে ধর্ম ও অর্থনীতি একই সূত্রে গাঁথা। যারা প্রকৃত ঈমানদার তারাই সঠিকভাবে রমজানের সিয়াম পালন করে। আর যারা প্রকৃত রোজাদার তারাই মুত্তাকী। যারা মুত্তাকী তারাই পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। যারা একমাস রমজানে সিয়ামের মাধ্যমে তাকওয়া নামক দুর্লভ গুণ অর্জন করেছেন। তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে।
বর্তমানে আমাদের সমাজে জাকাতের প্রতি যে অবহেলা দেখা যায়, তা দেখে মনে হয় জাকাত একটা দান-খয়রাত বা খেয়াল-খুশি ও দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপারমাত্র। দয়া পরবশ হয়ে যাকে মনে চায় দিলাম, মন চায় নাই দিলাম না। আবার যারা সামান্য দিতে আগ্রহ বোধ করেন তাদের মধ্যেও ‘সাধারণ সরকারি করের মত একটি ফাঁকির মনোভাব কাজ করে। কিন্তু আল কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জাকাত কোন দয়া-দাক্ষিণ্য বা দান-খয়রাতের বিষয় নয়। বরং এটি একটি অধিকার। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এবং তার ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের অধিকার রয়েছে।” (সুরা জারিয়াত-১৯) “তুমি কি সে ব্যক্তির কথা ভেবে দেখেছ যে শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করে, এ তো সে ব্যক্তি, যে নিরীহ ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দেয়, মিসকীনদের খানা দিতে যে কখনো উৎসাহ দেয়না।” (সুরা মাউন ১-৭)
দু’টি আয়াত থেকেই বুঝা যাচ্ছে যে, জাকাত প্রকৃতপক্ষে দাতার সম্পদ নহে বরং এটা বঞ্চিত ও মিসকিনদেরই হক। দাতা কেবল তার হক আদায়ের দায়িত্বটুকু পালন করলেন মাত্র। মনে রাখা প্রয়োজন, এটা তার কোন কৃতিত্বও নহে বা এটি বাহবা, সুনাম-সুখ্যাতি কুড়াবার কোন বিষয়ও নয়।
কোথাও প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সরকার না থাকলেও সালাত এবং রোজা যেমনি ভাবে তার সকল আহকাম ও আরকানসহ আমরা পালন করে থাকি, জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে এর সকল নিয়ম-কানুনের প্রতি অবশ্যই যতœবান হতে হবে। অন্যথায় সালাত ও রোজার আহকাম ও আরকান ছুটে গেলে যেমন সালাত ও রোযা ফাসেদ বা নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি নিজের খেয়াল খুশি মতো যাকাত প্রদান করা হলে তাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আর একটি বিষয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা হলো, “লোক দেখানো জাকাত” যা আমাদের দেশের একটি সংস্কৃতি হিসেবে উন্নতি লাভ করেছে তা থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটা সাধারণত সুনাম সূখ্যাতি ও বাহবা কুড়ানোর বিষয় নয়। যারা এমনটি করেন তাদের নিয়ত উপরের হামলা না করে অত্যন্ত সম্মানিত সহকারে অনুরোধ আল কুরআনের খাত অনুযায়ী যাকাত আদায় করুন।
এ সম্পর্কে আল কুরআনে আল্লাহর বলেন “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দানকে অন্যের উপরে নিজের অনুগ্রহ প্রচার করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করে দিও না, যে শুধু অন্যকে দেখাবার জন্য কিংবা সুনাম কিনার জন্য অর্থ ব্যয় করে অথচ সে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে: একটি মসৃণ পাথরখন্ডের উপর মাটির আস্তর জমেছিল। প্রবল বর্ষণের ফলে সমস্ত মাটি ধুয়ে গেলো। এখন সেখানে রয়ে গেল শুধু পরিস্কার পাথরখন্ডটি। এ সমস্ত লোকেরা দান-খয়রাত করে যে নেকী অর্জন করে বলে মনে তার কিছুই তার কাছে আসে না। আর আল্লাহ কাফেরদের সোজা পথ দেখান না।” (সুরা বাকারা-২৬৪) কাজেই রমজানের রোজা আমি পালন করছি কি না তা যেমন আমি আর আমার আল্লাহই ভাল জানেন, তেমনি দানের ব্যাপারটি ঐ রকই হওয়া উচিত। বলা হয়েছে যে তুমি এমনভাবে দান কর যে ডান হাতে দান করলে তোমার বাম হাত যেন তা জানতে না পারে।