ক্যান্সার বেড়েছে গৃহিণীদের
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:০০:১৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশে গত এক দশকে (২০১০ থেকে ২০২০) গৃহিণীদের মধ্যে ক্যান্সার বেড়েছে। বছরে শনাক্ত ক্যান্সার রোগীর প্রায় অর্ধেকই গৃহিণী। সাধারণত নারীদের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি। তবে অন্য পেশাজীবীদের চেয়ে গৃহিণীর হার সর্বোচ্চ। অস্বাস্থ্যকর জীবনাচারের ফলে যেসব রোগ প্রভাবিত হয়, সেসব রোগই ক্যান্সারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন ক্যান্সার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, গত দুই দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে নগরায়ণের পরিসর। বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মানুষের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত ও অতিপ্রক্রিয়াজাত (প্রসেসড ও আল্ট্রা প্রসেসড ফুড) খাবারে নির্ভরশীলতা বেড়েছে। কমেছে কায়িক শ্রম। গৃহিণীদেরও আগের মতো শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতাসহ অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব রোগের মধ্যে কোনো কোনোটায় পুরুষের চেয়ে নারী ভুক্তভোগীর হার বেশি।
দেশের একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। হাসপাতালটির ক্যান্সার রোগতত্ত্ব (ক্যান্সার এপিডেমিওলজি) বিভাগের গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘ক্যান্সার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট: ২০১৮-২০২০’ প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর হাসপাতালটিতে যত রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক গৃহিণী। এছাড়া শনাক্তদের মধ্যে গৃহিণীদের হার উত্তরোত্তর বাড়ছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালটিতে মোট ৮৩ হাজারের কিছু বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ৩৫ হাজারের। হাসপাতালটিতে ২০১৮ সালের পুরো বছরে পৌনে ১২ হাজার ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। পেশার বিভাজনে তাদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ গৃহিণী। ২০১৯ সালে সাড়ে ১২ হাজারের কিছু বেশি ক্যান্সার রোগীর মধ্যে রয়েছেন সর্বোচ্চসংখ্যক গৃহিণী। এ হার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। একইভাবে ২০২০ সালে সোয়া ১১ হাজার ক্যান্সার রোগীর মধ্যে গৃহিণীর হার ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশে সাধারণভাবে পুরুষের চেয়ে নারী ক্যান্সার রোগীর হার বেশি। এই তিন বছরেও জাতীয় এই হাসপাতালটিতে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির মধ্যে নারীর হার ছিল ৫৫ শতাংশ। তবে নারী-পুরুষ সবার পেশার বিভাজনে গৃহিণীদের ক্যান্সার বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে কোনো ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই। বছরে সারা দেশে কত রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন এমন হিসাব সরকারের নেই। তবে গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্স (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যানের আলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) সর্বশেষ হিসাবে জানিয়েছে, বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে শনাক্তকৃত রোগীর মধ্যে এখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত রয়েছেন ২ লাখ ৭১ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ক্যান্সার রোগীর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বছরে অন্তত তিন থেকে চার লাখের মতো মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন দেড় লাখ। এ হিসাব কোথাও তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। প্রাক্কলিত রোগীর সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ ক্যান্সার রোগী বছরে রোগ শনাক্তের বাইরে থেকে যায়। দেশে বিশেষায়িত পর্যায়ের (টারশিয়ারি) সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কমবেশি ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে। তবে সরকারিভাবে ক্যান্সারের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল এনআইসিআরএইচ। সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার রোগী ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দেশের সর্বোচ্চ এ হাসপাতালে আসছেন। তাদের তথ্যে তৈরি ক্যান্সার রেজিস্ট্রি দেশের ক্যান্সার রোগীর হিসাবের প্রতিনিধিত্ব করে।
এনআইসিআরএইচ জানায়, হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রথম তৈরি করা হয় ২০০৫ সালে। প্রতিবেদনটি ২০০৬ সালে প্রকাশ পায়। এরপর ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের তথ্যের আলোকে প্রতিবেদন প্রকাশ পায় ২০০৯ সালে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ পায় ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের রোগীর তথ্যে তৈরি ক্যান্সার রেজিস্ট্রি। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তথ্যে ২০১৪, ২০১৪ সালের তথ্যে ২০১৫ সালে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের তথ্যে ২০২০ সালের শেষে প্রকাশ পায় ক্যান্সার রেজিস্ট্রি। সর্বশেষ ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে ওই হাসপাতালে শনাক্ত হওয়া ক্যান্সার রোগীর তথ্য নিয়ে প্রস্তুতকৃত তথ্য গত ডিসেম্বরে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রকাশ করা হয়। এই তিন বছরে যত রোগী হাসপাতালে এসেছেন তাদের ৪৩ শতাংশের ক্ষেত্রে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে।
রেজিস্ট্রি প্রকাশের শুরু থেকে আক্রান্তদের সর্বোচ্চসংখ্যক গৃহিণী হলেও গত এক দশকে তাদের হার বেড়েছে। ২০১৮ সালের আগের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৪ সালে প্রকাশিত হাসপাতালভিত্তিক রেজিস্ট্রিতে মোট ক্যান্সার রোগীর ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ গৃহিণী, ২০১৫ সালে ৪১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে গৃহিণীদের হার ছিল ৪১ শতাংশ। গত দশকের আগের দশকের মধ্যে ২০০৬ সালে প্রকাশিত ২০০৫ সালের প্রতিবেদন বলছে, ওই বছর এনআইসিআরএইচে চিকিৎসা নেয়া ক্যান্সারের রোগীদের মধ্যে গৃহিণী ছিলেন ৩৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০০৯ সালে ৩৬ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৩৫ শতাংশ।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, আমাদের হাসপাতাল রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও ফলোআপ চিকিৎসা করে থাকে। এ সময় আর্থসামাজিক ও জনমিতির কয়েকটা প্রশ্ন থাকে। অন্যান্য গবেষণায়ও সাধারণত গৃহিণীদের ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। তবে সেসব এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ওপর করা গবেষণা। তাতে প্রকৃত তথ্য উঠে আসে। হাসপাতালে আগত সেবাগ্রহীতারা যে তথ্য দেন, তা নিয়েই ওই রেজিস্ট্রি প্রকাশ করা হয়। আমাদের যাচাই করার সুযোগ নেই। পুরুষদের মধ্যে চাকরিজীবীরা বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আর নারীদের মধ্যে গৃহিণীরা। তবে বর্তমানে সব মিলিয়ে গৃহিণীদের আক্রান্তের হার বেশি। ভারতে একটি গবেষণায় প্রায় ৭৮ শতাংশ ক্যান্সার রোগী গৃহিণী পাওয়া গেছে। দেশের অবস্থা বিস্তারিত বলতে হলে অবশ্যই এলাকাভিত্তিক গবেষণা করতে হবে।
তার মতে, অনেক নারী বিড়ির কারখানা, বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকের কাজ করেন। চিকিৎসা নিতে এসে তারা এসব বলতে চান না। বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থায় অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে গৃহিণী রোগী বেশি হবে। দেখতে হবে, গৃহিণীদের মধ্যে কোন ক্যান্সার বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কায়িক শ্রম কমে যাওয়া গৃহিণীদের ক্যান্সার প্রভাবিত করতে পারে। খাবারে পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের গৃহিণীরাও এখন কায়িক শ্রম কমিয়ে দিয়েছেন। তারা বসে থাকছেন বেশি। এতে স্থূলতা বেড়েছে। এই স্থূলতা ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ যেমন হূদরোগসহ অন্যান্য রোগকে প্রভাবিত করে, তেমনি ক্যান্সারকেও প্রভাবিত করে। এসব বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রভাবক। যার ক্যান্সার হয়েছে তার মধ্যে এসব রোগ থাকলে চিকিৎসা জটিল হয়। জেনিটিকের সঙ্গে (বংশগতি) সম্পর্কযুক্ত। স্তন, চোখের পর্দা ও কোলন ক্যান্সারসহ বেশকিছু ক্যান্সারের সঙ্গে জেনেটিকের সম্পর্ক রয়েছে।
গত বছর আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (এএইচএ) থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে নারী ও পুরুষদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে ৩১ শতাংশ বাড়লেও নারীদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ২০১১ সালে পুরুষদের মধ্যে ১৮ শতাংশ আর নারীদের মধ্যে ৩০ শতাংশের উচ্চরক্তচাপ পাওয়া যায়।
বিএমসি পাবলিক হেলথ জার্নালের এক গবেষণায় বলা হয়, বার্ধক্য, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ টু টাইপ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উচ্চরক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। এখানে প্রতি পাঁচজনে একজন স্থূলতায় ভুগছেন।
ক্যান্সার ও রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, নারীদের যেসব অঙ্গে ক্যান্সার হয় তা নারীদেরই হবে। জিনের কারণে ক্যান্সার হয় তবে সেখানে নির্দিষ্ট জিনের প্রবাহ থাকতে হবে। জিনগত কারণে ক্যান্সার এত প্রভাবিত হলে আগেও এমনটি থাকত। জিনগত কারণ ক্যান্সারকে প্রভাবিত করলেও জীবনাচারের কারণে ক্যান্সার হচ্ছে বেশি।