অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩৫:১৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, অপারেশন খরচ, স্যালাইন ও সার্জিক্যাল আইটেমসহ সকল ধরনের চিকিৎসা সামগ্রীর দামও লাগামহীনভাবে বাড়ছে । চিকিৎসা সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের ডাক্তার দেখানো থেকে ওষুধ খাওয়া পর্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে।১৫ হাজার টাকার সিজার অপারেশন করতে এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে। আবার ভালমানের প্রাইভেট হাসপাতালে তা ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। ওষুধ ও সার্জিক্যাল আইটের দামও আলাদা ভাবে বেশী নেয়। বাড়ছে হাসপাতালের সিট ভাড়াও। ডাক্তারের ফি (ভিজিট) ৫শ টাকা থেকে পদ মর্যাদা অনুয়ায়ী দুই হাজার টাকাও নেয়। প্রবীন চিকিৎসকরা মনে করেন, চিকিৎসাসেবা এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, জবাবদিহিতার অভাবে অনেক চিকিৎসক কর্মস্থলের চেয়ে চেম্বারে বেশী সময় দিচ্ছেন। আর কর্মস্থলে রোগী গেলে কিছু কিছু চিকিৎসক বাজে আচরণও করেন। খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু চিকিৎসক প্রায় রোগীদের সঙ্গে কর্মস্থলে বাজে আচরণ করেন। নিজে রোগী না দেখে ছাত্রদেরকে দিয়ে রোগী দেখান বলে অভিযোগ রয়েছে। দরকার হলে ছাত্রদের কাছে যেতে বলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে দেশে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম বাড়ছে। বাড়ছে ওষুধের কাঁচামালের (কেমিক্যাল) মূল্য। দেশজুড়ে ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেঙ্গুজ্বরের) চিকিৎসায় স্যালাইনের দাম এখনো লাগামহীন। দোকানে ওষুধ না রেখে গোডাউন থেকে এনে দিয়ে ওই স্যালাইন ৮৮ টাকা থেকে এখন ৩শ থেকে ৪শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বিদেশ থেকে স্যালাইন আমদানীকরেও কাজ হচ্ছে না। শুধু স্যালাইন না,সকল প্রকার ওষুধের মূল্য কম বেশী বাড়ছে। ওষুধ ছাড়াও সার্জিক্যাল আইটেম,ডেণ্টাল আইটেম,এক্রারে ফিল্মসহ প্রতিটি চিকিৎসা সামগ্রীর দাম কয়েকগুন বাড়ছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, দাঁতের এক্সরে ফিল্ম (অটো) আগে ছিল ১৪শ টাকা। এখন তা বেড়ে দাম হয়েছে ২২শ টাকা। দাঁতের মিরার্কেল মিক্্র ফিলিং আগে ছিল ৪ হাজার ৮শ টাকা। এখন তা বেড়ে ৭ হাজার টাকা হয়েছে। দাঁতের কম পোজিট ফিলিং মেট্রিয়াল আগে ছিল ১২শ টাকা। এখন তা বেড়ে ১৭শ টাকা হয়েছে। এই ভাবে শুধু দাঁতের ১০ থেকে ১২ ধরনের চিকিৎসা সামগ্রীর দাম লাগামহীন ভাবে বাড়ছে।ডায়বেটিস রোগীদের প্রতিদিন সকালের ও রাতের খাওয়ার প্রতিটি ওষুধের মূল্য বাড়ছে। এমনটি প্যারাসিটামল,নাপা, মোনাস, এণ্টিবায়োটিকসহ প্রতিটি ওষুধের মূল্য বাড়ছে। আমদানীকৃত ও সার্জিক্যাল আইটেমের মূল্য এখন অতিরিক্ত বাড়ছে।
এই সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ডলারের মূল্যসহ আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারনে ওষুধের মূল্য প্রকার বেধে শতকরা ১৫ ভাগ বাড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আর আমদানীকৃত বা বিদেশী ওষুধ আমদানী খরচের উপর নির্ভর করে মূল্য বাড়ছে। এরপর ওষুধ প্রশাসন থেকে বাজার তদারকি করছেন।রোগী ও স্বজনদের দেয়া তথ্য মতে, জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারের ফি কেউ কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কেউ কেউ পদ মর্যাদা অনুযায়ী চেম্বারে ফি ২ হাজার টাকাও নিচ্ছেন এখন। চেম্বারের ফি নিয়ে সুনিদিষ্ট কোন নীতিমালাও নেই। যে যেখানে যা পাচ্ছে তাই নিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বহু চিকিৎসক রাতভর চেম্বারে কাজ করে সকাল ৮টার দিকে আবার অফিসে গিয়ে রোগী না দেশে বিশ্রম নেয়। তখন কোন রোগী গেলেও রেগে যান। কিংবা জুনিয়র ডাক্তারের কাছে রোগী পাঠিয়ে দেন। আর তিনি মিটিং করছেন। বা ক্লাসে আছেন বলে রোগী না দেখে দরজা বন্ধ করে রুমে বসে থাকেন।অভিযোগ রয়েছে, অনেক চিকিৎসক হাসপাতালের বহিঃবিভাগে বসে ওষুধ কোম্পানী গুলোর পরামর্শে পছন্দের ওষুধ কিনতে প্রেশক্রিপশান দেন। আর অনেকেই বিকাশে আর্থিকসহ নানা ধরনের সুবিধাও নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে নি¤œমানের ওষুধে অনেক রোগীর উপকারও হয় না। বরং রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। আবার কমিশন পেতে অনেকেই বহু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া জানান, চেম্বারে চিকিৎসকরা ফি ৫শ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়। তিনি গত কয়েক বছর ধরে এক হাজার টাকাই নেন। ফি বাড়ানো হয়নি। অনেক রোগীকে ভিজিট ছাড়াই এমনি দেখে দেন। আবার সহায়তা করেন। কেউ কেউ দুই হাজার টাকা ফি নিতে পারেন। এটা তার জানা নেই। পদ মর্যাদা অনুযায়ী ফি নেয়া হয়। এটার কোন নীতিমালা নেই।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে সব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। এটা অপরাধ। কেউ কর্মস্থলে রোগী না দেখে ছাত্রদের কাছে পাঠিয়ে দিবে তাও ঠিক না। রোগীদের সঙ্গে সবার ভাল ব্যবহার করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানালজেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত বনিক জানান, চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেড়েছে। ১২শ টাকার বেড ভাড়া এখন আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। আগে সিজার করতে সার্জন নিত ১৫ হাজার টাকা। এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। যা আগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিল। আবার প্রাইভেট হাসপাতালে মোটামুটি কেউ নিত আগে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা হয়েছে। অপারেশনের অনেক জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে। কিছু কিছু চিকিৎসক তাদের ফি বাড়িয়েছে। এইভাবে অপারেশন আইটেমের অনেক জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তবে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে এখন খরচ এখনও অনেক কম।
এই বিশেষজ্ঞ হাসপাতালে কিছু কিছু ডাক্তারের বাজে আচরণের ঘটনা স্বীকার করেছে। এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কার্যালয়ে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিতে বলবেন। সরকারি হাসপাতালের বাজে আচরণের কারণে অনেকেই প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিদেশে চলে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন। আর কিছু কিছু ডাক্তার চেম্বারে বাড়তি ফি নিচ্ছেন বলে তিনি স্বীকার করেন।
মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক একজন এডিজি (অতিরিক্ত মহাপরিচালক) বলেন, জবাবদিহিতার অভাবে কিছু কিছু চিকিৎসক কর্মস্থলে রোগী দেখতে চায় না। কিংবা বাজে আচরণ করেন। তা তদারকি করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। কিছু কিছু ডাক্তারের বাজে আচরণের কারনে অনেক রোগী ভারত, থাইল্যান্ড অন্যান্য দেশে গিয়ে চিকিৎসা করেন।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সভাপতি প্রবীন চিকিৎসক ডাঃ ইকবাল আর্সলান বলেন, দেশের নিত্যপণ্যের বাজার যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তেমনি স্বাস্থ্য সেবা এখন পণ্যে পরিণত হচ্ছে। যে যার মত ফি নিচ্ছেন। বিল নিচ্ছে। এটা এখনই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু চিকিৎসকের রোগীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করা সম্পর্কে তিনি বলেন,এটা দুঃখ জনক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।