সিলেটে অবৈধ অস্ত্রে উদ্বেগ, বাড়ছে মজুদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ৭:৪৮:১৮ অপরাহ্ন
কারবারিদের তালিকায় রাজনৈতিক দলের নেতারা
এ টি এম তুরাব :
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বরাবরই নির্বাচনকে ঘিরে সীমান্তবর্তী সিলেটে শুরু হয় অবৈধ অস্ত্রের আতংক। এবারো এর ব্যতিক্রম নয়। ভোটের মাঠে নিজেদের ক্ষমতা জানান দিতে অনেকেই অবৈধ অস্ত্রের মজুদ করছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। এ নিয়ে আছে উদ্বেগ, আতংক।
তবে পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্রবাজদের সাথে কোন আপস নেই। অস্ত্রবাজদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। এলাকায় যারা অস্ত্রবাজ হিসেবে পরিচিত তাদের তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকায় অনেক রাঘববোয়ালের নাম আছে। কাউকে আমরা ছাড় দেওয়া হবেনা। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে সিলেটে শুরু হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া। রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত। ভোটের মাঠে নিজেদের ক্ষমতা জানান দিতে অনেকেই এসব অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করছে।
গত জুনে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিভিন্ন সময় নগরীতে বিভিন্ন প্রার্থীদের পক্ষে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সাত নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালিন কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন খানের নেতৃত্বে প্রতিদ্বন্দ্বি কাউন্সিলর প্রার্থীর বাড়ির সামনে অস্ত্র নিয়ে মহড়ার ঘটনাটি। মহড়ায় প্রদর্শিত আগ্নেয়াস্ত্রটি এখনো উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া গত এক বছরে সিলেট নগরীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অধিপত্যবিস্তার, গ্রুপিং দ্বন্দ্ব, জমি-জমা দখলসহ প্রায় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রায় সবকটি সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এতে অনেকে গুলিবৃদ্ধের পাশাপাশি নিহতও হয়েছেন। এসব ঘটনায় প্রদর্শিত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়নি। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
সূত্র বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেটে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত গড়ে তোলা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা কৌশলে সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢোকাচ্ছে এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। এরপর হাত ঘুরে চাহিদা মোতাবেক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। এসব অস্ত্র মিলছে ভাড়াতেও। রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী, দলীয় ক্যাডার থেকে শুরু করে পাড়ার ছিঁচকে মাস্তানরা এসব ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সিলেটে আটক হওয়ার পর রিমান্ডে থাকা অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রেতারা এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। মহানগর পুলিশের একটি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত অবৈধ অস্ত্রের হাতবদলে একেক সময় একেক ধরনের কৌশল নেয়া হয়। অবৈধ অস্ত্রের মজুদ নানা প্রয়োজনে গড়ে তোলা হয়। জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরেও অবৈধ অস্ত্রের চালান আসতে থাকে ভারত থেকে। জমি দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য নিয়ন্ত্রণেও অবৈধ অস্ত্রের মজুত গড়ে উঠছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অবৈধ অস্ত্র যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা না যায়, তাহলে দিন দিন ব্যবহার বাড়বে পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান, সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা এসব অস্ত্রের পুরোটাই সিলেটের সীমান্ত পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে। বিভিন্ন সময় দু’একটি অস্ত্রের চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করতে পারলেও বড় অংশই চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে। আর এই অস্ত্রধারীদের টার্গেট করেই সিলেটের বৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছেন অবৈধ গুলির মজুদ। এজন্য বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের এবার নজরদারীর আওতায় আনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইঘাট উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পথে ভারত থেকে খুব সহজেই অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। নির্বাচনকালে হওয়ার কারণে বর্তমানে তা আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব অস্ত্র বহনে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র কৃষক ও দিনমজুরদের। এই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত ও বাংলাদেশী অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।
সূত্র বলছে, সীমান্ত এলাকায় দুর্বল নজরদারি থাকার কারণে সহজেই অবৈধ অস্ত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে। মূলত অবৈধ অস্ত্রের হাতবদলে একেক সময় একেক ধরনের কৌশল নেয়া হয়। এই অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে একশ্রেণির চক্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে অস্ত্র মজুতের চেষ্টা করছে। তবে নজরদারির কারণে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে।
তালিকায় ৩১ জন কারবারি : সিলেটে ৩১ জন কারবারির নিয়ন্ত্রণে আছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অবৈধ অস্ত্রের বাজার। তালিকার পর তালিকা করেও এসব কারবারিদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বছর তিনেক আগে পুলিশের একটি সংস্থা সিলেটের অস্ত্র কারবারিদের একটি তালিকা করেছিলো। তালিকায় অনেক রাঘববোয়ালের নাম রয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের চারজন ও বিএনপির ৬ নেতার নাম রয়েছে। এই তালিকার বাহিরেও আরো অর্ধশতাধিক ব্যক্তি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িত বলে সূত্রটি জানায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক তৈরি হওয়া তালিকাটি প্রতিবেদকের হাতে এসে পৌঁছেছে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এই তালিকাটি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কোন অস্ত্রের দাম কতো : সিন্ডিকেটগুলো ভারত থেকে বেশিরভাগ আনে সেভেন পয়েন্ট ৬৫ এবং নাইন এমএম পিস্তল এবং পয়েন্ট ৩২ রিভলভার। তারা একে ২২ এবং একনলা বন্দুকও আনে। তবে এগুলোর চাহিদা বেশি নেই বলে ওঠে এসেছে পুলিশ তদন্তে। ভারতে একটি সেভেন পয়েন্ট ৬৫ পিস্তলের দাম ২০ হাজার টাকা হলেও বাংলাদেশে তা বিক্রি হয় ৪০-৮০ হাজার টাকায়। ভারতে পয়েন্ট ৩২ রিভলভারের দাম ২০ হাজার টাকা এবং নাইন এমএম পিস্তলের ৪০ হাজার টাকা। এগুলো এখানে ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্র। রাজনৈতিক সহিংসতা, শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার, গ্রুপিং দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অবৈধ অস্ত্র। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিলেটে বিভাগের চার জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। বিশেষ করে কানাইঘাট ও গোয়াইঘাট উপজেলার সীমান্ত এলাকা। ওইসব সিন্ডিকেট সেগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। এসব অস্ত্র মিলছে ভাড়াতেও। অনেক কারবারি রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্রগুলো আরো জানায়, অপরাধীদের কাছে স্পেন ও জার্মানির তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। অস্ত্রগুলো ওজনে হালকা, গুলি করার সময় শব্দ ও ঝাকুনি কম হওয়ার ফলে সহজেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এ ধরনের পিস্তল সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হচ্ছে অহরহ। রাজনৈতিক ক্যাডার ও অপরাধীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ছোট আকারের অস্ত্র। বহন ও ব্যবহারে নিরাপদ বলেই তারা ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। ৭৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকায় মিলছে অত্যাধুনিক অস্ত্র।
বহনে কারা ও পদ্ধতি কি : চক্রগুলো বাংলাদেশের ভেতরে অস্ত্র পরিবহনের জন্য মূলত নারী এবং পথ-শিশুদের ব্যবহার করে। একজন নারী এধরনের একটি পরিবহনের জন্য ৩ হাজার টাকা এবং পথ-শিশুরা ১০০ থেকে এক হাজার টাকা পায়। তদন্তকারীদের মতে, চক্রগুলো আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচার জন্য কিছু বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে। গাছ, গরু, গাড়ি, হাতি, ৬ একর জমি, ৯ একর জমি এবং বন্য গাছ আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য তাদের বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ। তারা বুলেটের জন্য চারা, বাছুর, লিপস্টিক এবং বীজ শব্দ ব্যবহার করে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়ানোর জন্য অস্ত্র পরিবহন করা হয় মিষ্টি বা বিস্কুটের প্যাকেট এবং চাল বা শাক-সবজির ব্যাগে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৯) এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মো. মোমিনুল হক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, অস্ত্রবাজদের সঙ্গে কোনো আপস নেই। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে র্যাবের অভিযান চলছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরীফ বিপিএম (বার) পিপিএম, দৈনিক জালালাবাদকে বলেন- অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে। এটা পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। শিগগিরই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান চালানো হবে।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান, বিপিএম (বার), পিপিএম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন- জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে নানা ধরনের অপতৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, বছরজুড়েই অবৈধ অস্ত্রে উদ্ধারে অভিযান চলে। কিন্তু নির্বাচনের আগে একটা বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে এটি শুরু হয়েছে। আমরা যখনই তথ্য পাচ্ছি, অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।