রাতের নগরে বেপরোয়া ট্রাক, সড়কে ঝরছে প্রাণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০:০১ অপরাহ্ন
নির্দেশনা ভেঙে ঢুকছে মালবোঝাই ট্রাক
এ টি এম তুরাব :
রাতের সিলেটে ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছে পণ্যবোঝাই ট্রাক। স্প্রিডব্রেকারের কোনো তোয়াক্কা না করেই ট্রাকগুলো তীব্র গতিতে ছুটে চলে। বেপরোয়া গতিতে ট্রাকগুলো নগরের বিভিন্ন মোড় পার হচ্ছে। এ সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকছে ছোট যানবাহনগুলো। এতে প্রতিনিয়তই ট্রাক চাপায় মারা যাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে নগরীর হুমায়ুন রশীদ চত্বরে ট্রাক চাপায় ছেলেসহ চিকিৎসক নিহত হন।
এদিকে নগরে দিন ও রাতে বেপরোয়াভাবে চলাচলকারী এসব ট্রাকের কারণে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ফলে নগরের ভেতরে ট্রাক চলাচল বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময় দাবি উঠলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২৯ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে নগরের আম্বরখানা পুলিশ ফাঁড়ি পাশে বেপরোয়া ট্রাক চাপায় এএসআই বোরহান উদ্দিন নামে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২৭ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শহরতলীর ধনপুর পয়েন্টে ট্রাক চাপায় বাদশা মিয়া (২২) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।
২৫ জুন বিকেল ৪টার দিকে নগরের নাইওরপুল পয়েন্ট ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে সফিক আহমদ (৬২) নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। গত ১৪ মে দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ট্রাকের চাপায় জাহাঙ্গীর মিয়া নামের এক মোটরসাইকেলচালক নিহত হন। একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সালুটিকরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের সাথে লেগে ইউপি চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ ইসহাক ও ছাত্রদল নেতা হাফিজুর রশীদ নিহত হন। ১২ জুলাই রাতে চিকনাগুল এলাকায় বেপরোয়া গতির ট্রাকের চাপায় পলাশ গোয়ালা নামের এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন।
২০২২ সালের ১৫ মে নগরের আখালিয়া এলাকায় ট্রাকচাপায় ফয়জুর রহমান এক মোটরসাইকেল আরোহী যুবক নিহত হন। এছাড়া ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি রাতে নগরের সুবিদবাজার এলাকায় ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা যান দুই মোটরসাইকেল আরোহী। একই দিন আরেকটি বেপরোয়া ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভেঙে দেয় দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বরের ফোয়ারা। এতে আহত হন ট্রাকচালক। একই বছরের ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর খাসদবির এলাকায় ট্রাকচাপায় এক পথচারীর নিহত হন।
সরেজমিনে দেখা যায়, সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট নগরীর বিভিন্ন সড়কে দেখা মেলে বিভিন্ন পণ্যবোঝাই ট্রাকের। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে নির্জন হতে থাকে সড়কগুলো। ফাঁকা নগরে রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে গাড়ির গতি। রাতের নগরে মালবোঝাই ট্রাক-পিকআপ আর ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে গতির প্রতিযোগিতায় নামে গাড়ি। বেশিরভাগ চালকই থাকেন মদ্যপ। যে কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
রাত ৯টা থেকে ভোর ৮টা পর্যন্ত সিলেট নগরের সড়কে থাকে ট্রাকের আধিপত্য। এই এগারো ঘণ্টায় প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকায় ছোট বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। যদিও ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী রাত ১০টার আগে নগরের রাস্তায় ট্রাক প্রবেশের নিয়ম নেই। তারপরও চালকরা নিয়ম ভেঙে দায়িত্বরত অসাধু ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের ম্যানেজ করে সময় বাঁচাতে সন্ধ্যার পর নগরের বিভিন্ন রাস্তা ব্যবহার শুরু করেন। তার ওপর বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
ট্রাক চালকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, তারা নগরের বিভিন্ন দোকানের মালামাল আনা নেওয়া এবং কাঁচামাল পরিবহনসহ বাণিজ্যিক কাজেই নগরীর ভেতরে সড়কে রাতভর চলাচল করেন।
মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নগরের ভেতরে ট্রাক চলাচলের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। তেমুখী পয়েন্ট হয়ে সিলেট নগরে ট্রাক ঢুকতে পারবে রাত ৯টার পর। কোম্পানীগঞ্জ থেকে আসা ট্রাক রাত ৯টা ও হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে রাত ১০টার পর নগরে ট্রাক ঢুকতে পারবে। নগরের ভেতরে চলাচল করতে পারবে সকাল ৮টা পর্যন্ত। এসব ট্রাক কেবল নগরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই, আম্বরখানা ও সুনামগঞ্জ সড়ক ব্যবহার করবে। তবে ট্রাকচালকরা এমন নির্দেশনা অমান্য করে সন্ধ্যার পর পরই ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়েন। নির্ধারিত সড়ক ছাড়াও উপশহর, শিবগঞ্জ, মিরাবাজার, সোবহানীঘাটসহ কয়েকটি সড়কে ট্রাক চলতে দেখা যায়। সেতুর টোল ফাঁকি ও সময় বাঁচাতে চালকরা নগরের ভেতর দিয়ে ট্রাক নিয়ে চলাচল করেন। এছাড়া পণ্য নিয়ে অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নামেন আরেক শ্রেণির চালক।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বেপরোয়া ট্রাক নিয়ন্ত্রণে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি। দুর্ঘটনা কমাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের সতর্ক হতে হবে। কারণ এসব সড়কে অন্যান্য পরিবহন চলাচল করলেও তুলনামূলক ট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনাই বেশি হয়।
ট্রাফিকের ডিসি আরো বলেন, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা রাত ১১টা পর্যন্ত সড়কে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর শুধু আম্বরখানা ও সুরমা বাইপাসে ট্রাফিক পুলিশ থাকে। তাই রাতে নগরে ট্রাক নিয়ন্ত্রণ কঠিন। ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে আমাদের কিছু করার নেই। যদি ওভারলোড কন্ট্রোল স্কেল থাকত, তবে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। তাছাড়া যদি রোড সাইন হিসেবে ‘পার্শ্ব রাস্তা, গতি কমান, ডানে মোড়’ ইত্যাদি সংকেত দিলে অনেকটাই দুর্ঘটনার শঙ্কা কমে আসবে।