দেশে মরুর উত্তাপ, কষ্টে ৭০% মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৪, ২:৩৭:৪৩ অপরাহ্ন
*যশোর-চুয়াডাঙ্গায় ৪৪ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই * হিটস্ট্রোকে ৯ দিনে ১১ মৃত্যু * ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ লোডশেডিং
জালালাবাদ রিপোর্ট : স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে ৪৫ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড গড়েছিল দেশ। এটা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তাপমাত্রার পারদ ৫২ বছরের সেই রেকর্ড যেন ভাঙতে বসেছে এবার।যশোরে মঙ্গলবার তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রায় এই দুই এলাকায় মরুর উত্তাপ বিরাজ করছে।
চলতি মৌসুমে টানা ৩১ দিন ধরে চলা দাবদাহ আরো কয়েককদিন স্থায়ী হতে পারে বলে আভাস দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস।অতি তীব্র তাপপ্রবাহে যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় মরুর উত্তাপ বিরাজ করছে। ঘরের বাইরে বের হলেই আগুনের হল্কা গায়ে লাগছে। শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। প্রচ- গরমে গলে গেছে যশোরের বেশ কয়েকটি পিচঢালা সড়ক।চলমান তাপপ্রবাহে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯ দিনে দেশজুড়ে হিট স্ট্রোকে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম (এইচইওসি/সিআর)। এর মধ্যে মাদারীপুরে দুইজন এবং বান্দরবান, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, হবিগঞ্জ, ঝিনাইদহ, খুলনা, লালমনিরহাট ও রাজবাড়ীতে একজন করে মারা গেছেন।
এপ্রিলের প্রথম দিনে উত্তরাঞ্চল দিয়ে শুরু হয়েছিল মৃদু তাপপ্রবাহ। ওই তাপপ্রবাহ সোমবার দেশের প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ২১ জেলার অধিবাসীরা তাপপ্রবাহের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। সিলেট ও নেত্রকোনা জেলায় তাপপ্রবাহ না থাকলেও তাপমাত্রা যথাক্রমে ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান তাপপ্রবাহের চিত্র তুলে ধরেছে এবং সারা দেশের তাপপ্রবাহ নিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেছে।
মানচিত্রে দেখা যায়, তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে ২১ জেলা। আর ১৪টি জেলা ২১ জেলার চেয়ে কিছুটা কম ঝুঁকিতে আছে। বাকি জেলাগুলো কিছুটা কম গরমের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ গরমের কারণে নানা মাত্রার ঝুঁকিতে বসবাস করছে। শুধু তা-ই নয়, গত ২৯ দিনে সারা দেশের গড় তাপমাত্রা এই প্রথম প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে।
গত বছরের জুনে কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়; অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়; চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছিল, দেশের পাঁচটি প্রধান শহরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রচণ্ড গরমের বিপদে রয়েছেন।আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র তুলে ধরেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সরকারের কাছে দেওয়া তাদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে কষ্ট ও বিপদে আছেন। এর বড় অংশ প্রচ- গরমের কারণে দৈনন্দিন কাজ করতে পারছে না। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণ :
‘বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে তাপপ্রবাহের বিপন্নতা: একটি মূল্যায়ন’ শীর্ষক যৌথ গবেষণায় দেশের বড় শহরগুলোয় তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এক. দ্রুত নগরায়ণ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ; দুই. ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়াগত পরিবর্তন।গবেষণায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়াগত কারণে সবচেয়ে কম তাপপ্রবাহপ্রবণ এলাকা হওয়ার কথা ছিল ঢাকা শহরের। আর রাজশাহী ও সিলেট সবচেয়ে তপ্ত শহর হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে তার উল্টো। ঢাকার ৭৮ শতাংশ বা ১ কোটি ২৫ লাখ মানুষ তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে পড়েছে। কিন্তু রাজশাহীতে ওই হার মাত্র ৪৫ শতাংশ বা ৪ লাখ মানুষ এ ঝুঁকিতে পড়েছে।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, এর আগে ২০১৪ সালে ৫-৩০ এপ্রিল টানা ২৬ দিন টানা তাপপ্রবাহ ছিল। ২০১৬ সালে ৬-৩০ এপ্রিল টানা ২৫ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। ২০২৩ সালে ১৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে টানা ২৩ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১৯৪৮ থেকে হিসাব করলে, গত ৭৬ বছরের মধ্যে এবারের দাবদাহের স্থায়িত্ব বেশি। আর এই দাবদাহ বিস্তৃত হয়েছে বিশাল এলাকা নিয়ে। দীর্ঘসময় ধরে চলা তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। হিট স্ট্রোকে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। গরমে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে পানি সংকট।
বাংলাদেশে মে মাসেও গরমের দাপট যে বেশি থাকে, সে কথা তুলে ধরে ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইন্সটিটিউটের (এনএওএমআই) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ১৯৭২ সালে এই মে মাসেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শেষ তিন দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত ও শীতের দিন কমছে, বছরের বড় অংশজুড়ে গরমের বিস্তার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে এপ্রিল মাস আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
এদিকে, গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এটিকে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে মনে করছেন গ্রাহকরা। বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সোমবার বেলা ৩টার দিকে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট। এ সময় তারা সরবরাহ পেয়েছে ৫ হাজার ৯৯৭ মেগাওয়াট। ৩৭ শতাংশ ঘাটতি তারা পূরণ করেছে লোডশেডিং দিয়ে। এতে দেশের একটি বড় অংশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পাননি মানুষ। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা থেকে পরিকল্পনামতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে বকেয়া বিলের জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে উৎপাদন করা যাচ্ছে না।