কৃষকের ধান কিনছেন দালাল সুনামগঞ্জে ধানের মাপে শুভঙ্করের ফাঁকি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২৪, ৯:৪৩:৫৩ অপরাহ্ন
জামালগঞ্জ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জে ঈদকে সামনে রেখে গ্রামে-গ্রামে চলছে নতুন ধান কেনা-বেচা। ধান বুঝে দর দাম ঠিক করছেন পাইকাররা। স্থানীয় ভাষায় ধান কেনার পাইকারকে দালাল বলে অভিহিত করেন বিক্রেতারা।
কৃষকের সারা বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল ধান বিক্রির সময় শুভঙ্করের ফাঁকিতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের আগেই অনেক কৃষকের গোলা ধানশূন্য হচ্ছে। তারা নিজস্ব জমিতে ধান চাষ করে শ্রমিকের মজুরি দিয়ে উৎপাদিত ধানে লাভের মুখ দেখছেন না। মহাজনী ঋণ শোধ করতে ধান কাটার সাথে সাথেই উঠান থেকে কম দামে ধান বিক্রি করতে হয় তাদের। সরকারিভাবে ধান ক্রয় শুরুর আগেই কৃষকেরা সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে (প্রতিমণ) ধান বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় ব্যাপারীদের (দালাল) কাছে।
সরকারীভাবে সুনামগঞ্জে এবার ২৯ হাজার ১১ মে: টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৩২ টাকা কেজি দামে প্রতিমণ ধান ১ হাজার ২৮০ টাকা দরে ক্রয় করা হবে খাদ্যগোদামে। তবে অনেক কৃষকের অভিযোগ, এক শ্রেণীর দালালচক্র গ্রামের কৃষকদের কৃষিকার্ড সংগ্রহ করে তাদের নামে ধান বিক্রি করে, কার্ডধারী কৃষককে যৎসামান্য টাকা বিনিময় করে থাকে। ইউনিয়নভিত্তিক পয়েন্টে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের দাবী জানান কৃষকরা। এতে তারা কিছুটা হলেও সরকারী সুফল ভোগ করতে পারতেন।
এবার জেলার মল্লিকপুর খাদ্য গুদামে-১১৭৫ মে: টন, শান্তিগঞ্জে-২৯৯৪ মে: টন, দোয়ারাবাজারে-১৫৩৬ মে: টন, ছাতকে-১৮০৮ মে: টন, জগন্নাথপুর-১৬৭৮ মে: টন, রাণীগঞ্জ-৯৩০ মে: টন, দিরাই- ৪৭১৮ মে: টন, গুঙিয়ারগাঁও-৩৪৯৮ মে: টন, ধর্মপাশা-১৫০০ মে: টন, মধ্যনগর-২৩৯৫ মে: টন, সাচনা-৩১২৬ মে: টন, তাহিরপুর- ২৪৯৮ মে: টন, বিশ্বম্ভরপুর-২৪৫৫ মে: টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
শহরতলী ছাড়াও পল্লী গ্রামের কৃষকরা সরকারীভাবে ধানক্রয়ের কথা এখনো জানেন না। সারাবছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল বৈশাখে উৎপাদিত ধান বিক্রিতে ঠকছেন, আবার কৃষি কাজের সময় জীবন বাঁচাতে এই কৃষকদেরই চাল কিনতে হয় বেশী দামে। এ যেন শাখের করাতে তাদের জীবন বন্দি।
জেলার পাকনা হাওরের কৃষক কয়েছ মিয়া জানান, ৩৩ শতকে এক বিঘা জমিতে বিআর-২৮ ধান চাষ করে বীজ বপন থেকে শুরু করে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। চলতি বছর ধান উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ ১২-১৬ মণ। ধান কাটার সময় শ্রমিকের মজুরি আর ঋণ দিয়ে গড় পড়তায় তেমন ধান থাকেনা। তবে যারা নিজেরাই নিজেদের জমিতে কাজ করে তাদের হিসাব ভিন্ন।
সরকারি ধান সংগ্রহের আগেই ধান মাপার দালাল বা কয়ালরা গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার মন ধান মাপতে এক ধরনের বিশেষ গণনারীতি ব্যবহার করে। দেশের কোথাও এ ধরনের গণনারীতির প্রচলন নেই। সাধারণ গণনা হতে এ গণনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ মানুষের পক্ষে এ গণনা বুঝা খুবই কষ্টকর। দালালরা ধান মাপার সময় ‘নাক্কা সুরে গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে একই সংখ্যা কথায় বার বার বলে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। কোনো সংখ্যাই তারা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন না। ধান মাপার শুরুতেই ‘লাভে রে লাভ, লাভে রে লাভ (এক), দুইয়া, তিনেরে, চাইরো এভাবে ‘নাইশা’ (উনিশ), ‘উনদিশা (ঊনত্রিশ),‘অইনচা (ঊনচল্লিশ), চাইলা (চল্লিশ), পর্যন্ত প্রত্যেকটা সংখ্যার একটা বিকৃত রূপ সৃষ্টি করে জোরে জোরে বার বার তা উচ্চারণ করে। ‘অইনচা (ঊনচল্লিশ) থেকে সহজেই ‘নাইশা (ঊনিশ)’ তে ফিরে আসলে কারো ভুল ধরার উপায় নেই। এমন ভেল্কিবাজি দিয়ে যুগের পর যুগ ধান বিক্রিতে হাওরের সহজ সরল কৃষকেরা প্রতিনিয়তই ঠকছেন।
কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, কয়াল-দালালরা এক তালে ‘চল্লিশ পাল্লা বা পাঁচ মণ ধান মাপার পর দৃশ্যমানভাবেই প্রায় ২ কেজি খানেক ধান অতিরিক্ত নেন। অনেক সময় ‘অইনচা (ঊনচল্লিশ) ছেড়ে ‘অনদিশা (ঊনত্রিশ) চলে আসার দেন দরবার শোনা গেছে। ধান কেনার বেপারির সাথে ‘কয়াল-দালালের দৃশ্যমান চুক্তি হচ্ছে এক মণ ধান মাপে কয়াল-দালালরা ১০-১২ টাকা মজুরী পান। বেশি পরিমাণ ধান দিতে পারলে ‘কয়ালি-দালালের টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়। কোন বেপারিই কয়াল-দালাল ছাড়া সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করেন না। দালালরা বেশি দামে ধান কিনে আড়তে কম দামে বিক্রি করলেও ধান ক্রেতার (বেপারির) লাভ থাকে।
ধান কেনার দালাল-কয়াল রমিজ আলী বলেন, আমরা মাপে কারচুপি করি না নিয়ম মতোই ধান মাপি। ধান কাটার সাথে সাথে আশুগঞ্জ-ভৈরব, ফতুল্লাসহ বেশ কয়েক জায়গার বেপারী আসে। এ সময় এলাকার কৃষকের হাতে টাকা থাকে না এ কারণে কম দামে ধান বিক্রি করে কৃষকেরা।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভুঁইয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, আমরা সরকারীভাবে ধান ক্রয়ের পূর্বে মাইকিং করাই। সরকারিভাবে প্রতি কেজি ধান ৩২ টাকা দরে মণপ্রতি ১২শত ৮০ টাকা নির্ধারণ হয়েছে। সরকারিভাবে লটারীর মাধ্যমে ধান ক্রয় শুরু হয়েছে। প্রকৃত কার্ডধারি কৃষক যারা তাদের ধানের আদ্রতা ও গুণগতমান দেখে ক্রয় করা হচ্ছে।