সিলেটে সর্বত্র বন্যার ক্ষত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৪, ১:০০:৫২ অপরাহ্ন
ঘর-বাড়ি, ফসলিজমি, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি
এ টি এম তুরাব :
ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া সিলেটে ক্ষয়ক্ষতির যেন শেষ নেই। ঘর-বাড়ি, ফসলিজমি, রাস্তাঘাট, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। আটকে থাকা পানি নামার সাথে সাথে এখন সর্বত্র দৃশ্যমান হচ্ছে ধ্বংসস্তূপের চিত্র। তবে এখনো পানিতে টইটুম্বুর সিলেটের বেশ কয়েকটি উপজেলা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এছাড়া ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ হাজার ৫০৬ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে। আর ১৩টি উপজেলার ২১ হাজার ১১১টি পুকুর-দিঘি-খামার বন্যায় ভেসে গেছে।
সড়ক : বন্যার ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন সড়কগুলো দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। বন্যার ভয়াবহতা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে এই সড়কের ক্ষত চিহ্নগুলো দেখার পর। পানির চাপ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ঘূর্ণিঝড়ে গাছ-ঘরবাড়ি যেমন দুমড়েমুচড়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে দুমড়েমুচড়ে গেছে সড়ক।
সড়ক বিভাগ ও এলজিইডি সূত্র বলছে, জেলার সড়ক বিভাগের ১৩ উপজেলায় ১৬০ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ১১৯ কোটি টাকা। আর সড়ক ও সেতু বিভাগের তথ্য মতে, বন্যায় সিলেট জেলার ৪০ কিলোমিটার সড়কে পানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকার ক্ষতি।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় নগরের ২৫০ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। এতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ফসলি জমি : চলতি বন্যায় সিলেটের ১৩ উপজেলার ১৫ হাজার ৫০৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার ৯৮ হাজার ৬৫৩ কৃষক। জেলায় এবার আউশ বীজতলা, সবজি ও বোনা আমন ধানের ২০ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমি আবাদ করা হয়েছিলো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, বন্যায় মোট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ২৭৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। এরমধ্যে আমন ধান চাষিদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদেরও প্রণোদনা দেয়া হবে।
মৎস্য : সিলেট জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় সিলেট জেলায় ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জেলায় ২১ হাজার ১১১টি পুকুর-দিঘী-খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সীমা রাণী বিশ্বাস বলেন, সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জকিগঞ্জে। এ উপজেলার ৬ হাজার ৭৫৫টি পুকুর-দিঘি-খামারের মাছ ভেসে গিয়ে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্বাস্থ্য : সিলেটের স্বাস্থ্যখাতেও নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেট শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেনারেটর জলমগ্ন হওয়ায় হাসপাতালের বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। নিচতলায় পানি উঠে যাওয়ায় রোগীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। পানি নামার পর দেখা যায়, হাসপাতালটির এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রেডিও থেরাপি মেশিনে পানি ঢুকে গেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে এসব সেবাকার্যক্রম। এবারের বন্যায় শুধু ওসমানী হাসপাতালেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বিভাগের অনেক সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে বিভাগজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হচ্ছে।
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সকল উপদ্রুত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, ইপিআই আইএলআর ফ্রিজ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, এক্সরে মেশিন, এমএসআর সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। জলমগ্ন এসব যন্ত্রপাতি কতটা সচল কিংবা অচল তা পানি নেমে না যাওয়ায় যাচাই করা যাচ্ছে না। সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে আরো সময় লাগবে।
![](https://dailyjalalabad.com/files/uploads/2024/06/guanighat.jpg)
বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদফতর উল্লেখ করে, সিলেট বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যাকবলিত হয়েছে। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মধ্যে ৩১টিতে পানি ঢুকেছে। সুনামগঞ্জে দু’টি হাসপাতালে পানি প্রবেশ করে। এছাড়াও ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি ক্লিনিক পানিতে নিমজ্জিত হয়। জেলার তিনটি উপজেলা (জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ) বাদ দিয়ে বাকি ১০টি উপজেলার সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন ছিল। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় ১০ ফুট পরিমাণ পানি ছিল। স্রোতের কারণে অনেক আসবাবপত্র ভেসে গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের।
এদিকে বিভাগের চার জেলায় এখনো অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। কেবল সিলেটের সুরমা অঞ্চল ঘেরা বিভিন্ন নদীর পানি কিছুটা কমার খবর পাওয়া গেছে। অন্য দিকে সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকায় বন্যার পানি কমেছে। তবে এখন রাস্তাঘাটে জমে থাকা বন্যার ময়লা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। পানি কমতে শুরু করায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
গতকাল নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান সড়কগুলোর যেসব স্থানে পানি জমে ছিল, সেগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। তবে কিছু সড়কে এখনো পানি রয়েছে। এরমধ্যে শাহজালাল উপশহরের কিছু গলিসড়কসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোতেও পানি রয়ে গেছে। তবে সব কয়টি সড়কেই যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। নগরের যতরপুর, উপশহর, সোবহানীঘাট এলাকার পাড়া-মহল্লার পানি ময়লা ও কালো রঙ ধারণ করেছে। এসব স্থানে জমে থাকা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। উপশহর এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদ চৌধুরী নাহিদ বলেন, পানি কমে যাওয়ার পর নতুন করে ভোগান্তি শুরু হয়েছে। আগে বেশি পানি থাকায় পানি কিছুটা ঘোলা থাকলেও তেমন ময়লা ছিল না। এখন পানি ময়লা হয়ে কালো রঙ ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত ময়লা পানি মাড়িয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। এতে সবার পায়ে চুলকানি হচ্ছে।