আমলাদের দুর্নীতিতে বিব্রত আওয়ামী লীগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৪, ৮:৩৬:৩৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে আমলাদের দুর্নীতিতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে দলটি। দলের বিভিন্ন ফোরামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমলাদের দুর্নীতির আদ্যপান্ত। তাদের অভিযোগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমলারা এতবড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সাহস পায় কীভাবে।আমলাদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? কেউ কেউ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের মন্ত্রী থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দিকেও ব্যর্থতার আঙ্গুল তুলছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির বিধিমালা-২০১৮ সংস্কারেরও দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা।
সম্প্রতি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তিনি ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন। এর আগে ২০১২ সাল থেকে চার বছর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নেতৃত্ব দেন। চলতি বছরের মে মাসে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।
অন্যদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ঢাকায় মোট ১২টি ফ্ল্যাট, বিভিন্ন জেলায় ৬৯৭ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু নিজের নামে নয়, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামেও বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। তার পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি, পূর্বাচলের সেক্টর ৮, রোড ১০৮-এ ৫২ নম্বর ৫ কাঠার প্লটটি বিক্রি করেছেন। আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের, এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর প্লটে ২১ কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠার ওপর ৬ তলাবিশিষ্ট আলিশান বাড়ি, নিকুঞ্জ-১-এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়ি, সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে ৩ নম্বর ভবনে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার স্কয়ার বর্গফিটের একটি ফ্ল্যাট, ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে একটি ফ্ল্যাট, ধানম-ির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়ির বি/২/৫ ভবনে এককাঠা জমিসহ একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া জমি রয়েছে ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় ৪১ শতাংশ জমি, একই মৌজায় ২৬ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ জমি। জোয়ারসাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি, একই মৌজায় ১০ কাঠা জমি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর জমি, একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি, ওই মৌজায় দশমিক ৫৭ একর জমি। দুটি কোম্পানির অংশীদার হলেন আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। এর মধ্যে একটি মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি।
ছাগলকা-ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী, পাঁচ সন্তানের সাংসারিক দায়িত্ব পালনের পরও তাদের ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এ পর্যন্ত দেশেই তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকাতেই অন্তত ২৪টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, যেখানে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বারবার বলে আসছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সেখানে আমলারা কীভাবে সাহস পান দুর্নীতিতে জড়াতে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সত্যি আওয়ামী লীগ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। কারণ এই সরকারি কর্মকর্তারা সবাই এই সরকারের আমলে। শুধু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদেরই নয়, আরও যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদেরও খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। কিন্তু তারপরও তারা এত সাহস পায় কী করে। এ জন্য দুদকসহ গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজ করার কথাও বলেন তিনি।
গত মঙ্গলবার সংসদে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, চাকরিতে নিয়োগের সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হলফনামা দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। এরপর তিনি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর বা পদোন্নতির সময় হলফনামা দিতে হবে। এ নিয়ম চালু করলে তাদের কী পরিমাণ আয় বা সম্পদ বাড়ছে তা জানা যাবে, দুর্নীতি কমবে। সরকারি কর্মকর্তারা হলফনামা না দিলেও একজন রাজনীতিবিদকে তো হলফনামা দিতে হয়। সরকারের জন্য দুর্নীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এখনও কিন্তু দুর্নীতি দমন করতে পারিনি। দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ থাকলে কখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, যেটা লক্ষ করা যাচ্ছে এখন। এবার কুরবানির ঈদে একটি গরু ১ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ গরুটা কারা কিনল, কেন কিনল। যাদের অবৈধ আয় আছে, তারা নিশ্চয়ই কিনেছে। আবার ১৫ লাখ টাকায় অবৈধ আয়ধারীরা ছাগলও কিনেছে। আবার অনেক সময় বড় বড় কর্মকর্তারা বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত থাকলেও তাদের সামান্য পরিমাণে শাস্তি হয়। অথচ নন-ক্যাডার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাদের সরকারি চাকরিতে আর বহাল থাকতে পারে না। একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা হলে তাদের গ্রেফতারে কোনো পারমিশন লাগে না। কিন্তু যদি সরকারি কর্মীদের একই অভিযোগে মামলা হয়, তাহলে গ্রেফতার করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে। এই সরকারি কর্মকর্তা আইন ২০১৮ এটাই দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে। আইনটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যখন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে তখন ওই গোষ্ঠীর বা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সাফাই বিবৃতি যাতে না দেওয়া হয়। এতে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকারান্তরে সেই গোষ্ঠীর ওপর গিয়েই পড়ে। আমরা দুর্নীতিবাজদের পক্ষ কেউ অবলম্বন করব না। মতিউর রহমানের মতো দুর্নীতিবাজকে দুদক, সরকারি সংস্থা, মিডিয়া, আমরা কেউই চিহ্নিত করতে পারিনি। তাকে চিহ্নিত করেছে একটি বোবা প্রাণী ছাগল। সরকারে মতিয়ারের মতো এমন কোনো দুর্নীতিবাজ আর আছে কি না তা কোনো বোবা প্রাণী বের করে আনার আগে সরকারি সংস্থাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনো দুর্নীতিবাজকে রেহাই দেওয়া যাবে না।