ফের বৃষ্টি ও ঢলের চোখ রাঙানি : বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়ার শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জুন ২০২৪, ১২:২০:৩২ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : ফের বৃষ্টি ও ভারতীয় ঢল চোখ রাঙানি দিচ্ছে। সিলেটে ও উজানে ভারতের রাজ্যগুলোতে বৃষ্টিপাত বেড়ে আগামী তিনদিনে সিলেট-সুনামগঞ্জে বিস্তৃর্ণএলাকা ফের প্লাাবিত হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এমন পূর্বাভাস দিয়েছে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী তিনদিনে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীসমূহের পানির সমতল বাড়তে পারে। এ সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সারিগোয়াইন নদীর পানির সমতল দ্রুত বেড়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে একটু দমকা বাতাসও দেখা যাচ্ছে। এখন যে পূর্বাভাস তাতেও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতের সমুহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি যে, ৩০ জুনের পর থেকে দুই থেকে তিনদিন ব্যাপক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় সিলেটে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৮৮ থেকে ৮৯ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন বলেছেন, ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস পেয়ে সিলেটের প্রত্যেক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। ওই নির্দেশনার আলোকে জেলা প্রশাসন প্রস্তুতি নিয়েছে।
এদিকে, বর্তমানে সিলেটের সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার নিচে থাকলেও ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দ্বিতীয় দফা বন্যার পানি এখনো চারটি উপজেলা থেকে নামেনি। এই চারটি উপজেলা হচ্ছে; ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ। কুশিয়ারা অববাহিকার জনপদ চার উপজেলা। ইতিমধ্যে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পানি কমলেও চার উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে বন্যা। গতকাল মাত্র দুই ইঞ্চি পরিমাণ পানি কমেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এই চার উপজেলার মধ্যখানে ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদী। এটির সংযোগস্থল সিলেটের উজানের উপজেলাগুলোর পাশাপাশি মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার।
বলতে গেলে মৌলভীবাজারের পানি অপসারণেরও একমাত্র পথ কুশিয়ারা। ফলে অমলসীদ দিয়ে তেমন পানি না এলেও হাকালুকি হাওরের পানির কারণে ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমছে ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার। আবার বৃষ্টি হলে পানি বেড়ে যায়। এ কারণে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো মানুষের বসবাস। চার উপজেলায় গ্রামীণ রাস্তায়ও পানি। গত ১১ দিন ধরে চরম দুর্ভোগে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। বন্যা স্থায়ী রূপ নেয়ায় অনাহারে, অর্ধাহারে কাটছে মানুষের জীবন।
বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে পানি। কুশিয়ারা নদীর তীরে এই দুই উপজেলা সদরের অবস্থান। দুই সপ্তাহ ধরে পানি থাকায় অর্ধেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- আগে ছিল কোমর পানি। কয়েকদিনে ধীরে ধীরে পানি কমে এখন সেটি হাঁটু পানিতে এসে ঠেকেছে। এখন পানি কমছে খুব ধীরে। এ কারণে বিশেষ করে বালাগঞ্জের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হচ্ছে না। উপজেলার ৬০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরতে পারছে না।
বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আনহার মিয়া জানিয়েছেন- দুই জেলারই পানির বেসিন হচ্ছে বালাগঞ্জ, ওসমানীগর হয়ে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদী। যেটুকু পানি কমছে, উজান থেকে ফের সে পরিমাণ পানি চলে আসছে। তিনি বলেন- বন্যার্তদের মধ্যে খাবার সংকট নেই। কিন্তু পানিবন্দি থাকার কারণে মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। অনেক স্থানে যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
বন্যাকবলিত চার উপজেলার মধ্যে ভাটির উপজেলা হচ্ছে ওসমানীনগর। এ কারণে এ উপজেলার পশ্চিম পৈলনপুর, সাদিপুর ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি সূচনীয়। এই দুই ইউনিয়নে পানি কমছে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর। উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ জানিয়েছেন- পশ্চিম পৈলনপুর ও সাদিপুরসহ গোটা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে। পানি কমছে ধীরগতিতে। যেভাবে রাতারাতি পানি বেড়েছিল সেভাবে কমছে না। এ কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এই অবস্থায় তারা গোটা উপজেলায়ই ত্রাণ কার্যক্রমে গতি বাড়িয়েছেন। তিনি জানান- তার উপজেলায় ৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৩৩শ’ মানুষ অবস্থান করছে।
এদিকে ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে হাকালুকি হাওর এসে মিশেছে কুশিয়ারা নদীতে। অন্যদিকে মনু নদী হয়ে পানি আসে। ফলে ফেঞ্চুগঞ্জের হাওর তীরবর্তীর অবস্থা করুণ। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। এসব এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোও কষ্টকর। একই অবস্থা গোলাপগঞ্জের হাওর এলাকারও।
দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি তীরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা এই তিনটি উপজেলার প্রায় তিন লাখ বন্যাকবলিত মানুষ এখনো চরম দুর্দশায়। মৌলভীবাজার জেলায় বন্যার ১৩ দিন চলমান। এ জেলার সাতটি উপজেলার নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও হাওর এলাকায় ভিন্ন রূপ। বিশেষ করে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় পানি না কমায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী তিন উপজেলার বানভাসি মানুষ।
এ অবস্থায় নতুন করে বৃষ্টি ও উজানের ঢল নামলে এসব এলাকার বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। এতে দুর্ভোগ-ভোগান্তির সীমা থাকবেনা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।এদিকে পাউবো জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের পর্যবেক্ষণাধীন ১১০টি স্টেশনের মধ্যে শুক্রবার পানির সমতল বেড়েছে ৪৭টিতে, কমেছে ৫৫টিতে। অপরিবর্তিত আছে একটি স্টেশনের পানির সমতল। তথ্য পাওয়া যায়নি একটির।