দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে বন্যা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২৪, ৩:৩০:১০ অপরাহ্ন
সুরমা উপচে ঢুকছে পানি
মানুষের রুদ্ধশ্বাস সময়
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটে গতকাল বুধবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। দিনের কিছুটা অংশ রোদেরও দেখা মিলেছে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি যেমন ছিলো তেমনই আছে। বরং কোথাও কোথাও পানি বেড়েছে। আর দিন যত যাচ্ছে মানুষের রুদ্ধশ্বাস ও দীর্ঘশ্বাসের মাত্রাও বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, সুরমা উপচে গতকালও সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকেছে পানি। নগরের ভেতরের ছড়া-নালা পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আর সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলাই বন্যা প্লাবিত। সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি তেমন কোন উন্নতি হয়নি। মৌলভীবাজারেও দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে বন্যা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৬টি পয়েন্টেই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময় সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর পানি অমলশিদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৯ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এছাড়া দুই দফা বন্যায় সব নদ-নদী ও হাওর এলাকা পানি ভর্তি থাকায় পানি নামার গতি নেই।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, সিলেটে বুধবার শেষ ১২ ঘন্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ মিলিমিটার। বৃষ্টি রাতে আরো বাড়তে পারে।
সিলেট নগর :
সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট বিপদসীমার উপরে থাকায় গতকাল নতুন করে নগরের ভেতরে প্রবেশ করেছে পানি। নালা-ছড়া হয়ে বিভিন্ন এলাকা পানিতে টাইটুম্বুর। উপশহর, শেখঘাট, কুশিঘাট, তালতলা, কাজীরবাজার, কলাপাড়া, মেন্দিবাগ, দক্ষিণ সুরমাসহ নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে কোথাও কোথাও কোমর সমান পানি পর্যন্ত উঠেছে। একইসাথে নগরের শিবগঞ্জ, সোবহানীঘাট, যতরপুর, মীরাবাজার, শামীমাবাদ, মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা ও চৌকিদেখী এলাকাসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। গতকাল দুপুর থেকে বৃষ্টি কমায় পানি কিছুটা কমলেও জলাবদ্ধতা রয়েই গেছে। আর শেষ বিকেলে বৃষ্টি শুরু হলে এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার পরিমাণও বাড়ে।
উপশহরের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বুধবার নতুন করে পানি ঢুকেছে এলাকায়। এতে অসংখ্য বাসার নিচতলায় পানি উঠেছে। তাই বাসা বাড়ি ছেড়ে অনেকে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। উপশহরের নিচু ব্লকগুলোর নিচতলা প্রায় খালি অবস্থায় রয়েছে। এতে চুরি-ডাকাতিরও আশঙ্কা করছেন তারা।
উপশহরের মতো অন্য নিচু এলাকাগুলোও ছাড়ছেন বাসিন্দারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফেরার অপেক্ষায় তারা।
সিলেটে এর আগে গত ২৮ মে থেকে ভারী বৃষ্টির ফলে প্রথম দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে গত ১৬ জুন আবার বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েন সিলেটের বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে গতকাল পর্যন্ত ষষ্ঠবারের মতো জলাবদ্ধ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন সিলেট নগরের বাসিন্দারা।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ শাখা জানায়, পানি বাড়ায় নগরের মীরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে ৮০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। যেভাবে সুরমা উপচে পানি ঢুকছে তাতে আজ-কালের মধ্যে আরো মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
সিলেট জেলার সব উপজেলা প্লাবিত :
বন্যার পানিতে জেলার ১৩ উপজেলাই কম-বেশি প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলার ৯১টি ইউনিয়ন ও ১ হাজার ১৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৭ লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
সিলেটে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ সবচেয়ে বেশি বন্যার কবলে পড়েছে। তবে প্লাবিত হয়েছে সব কটি উপজেলাই।
সালুটিকর – গোয়াইনঘাট, গোয়াইনঘাট-রাধানগর ও হাতির পড়া-ফতেহপুর সড়কগুলোর বিচ্ছিন্ন অংশ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সবচেয়ে বেশি বন্যা আক্রান্ত মানুষ ওসমানীনগর উপজেলায়। এ উপজেলায় বন্যা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ৮২ হাজার। এরপর গোয়াইনঘাটে ৯৮ হাজার ৬০০ ও কোম্পানীগঞ্জে ৯৪ হাজার ৩৮৫। জেলায় ৬৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ হাজার ৮১৮ জন বানভাসী আশ্রয় নিয়েছেন।
সরকারী হিসেবে বন্যা আক্রান্ত সংখ্যা ৭ লাখ হলেও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশী। এসব এলাকাগুলো মানুষের কষ্টের শেষ নেই। কিন্তু সে অনুযায়ী এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা নেই।
সুনামগঞ্জে অপরিবর্তিত বন্যা পরিস্থিতি :
ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলার সব জায়গায় কমবেশি বন্যা আছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, এখনো সুনামগঞ্জে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৩১ মানুষ বন্যাকবলিত। বুধবার দুপুর পর্যন্ত ৬০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৩৭ মানুষ আছেন।
সুনামগঞ্জে এখনো বিপদসীমার উপরে সুরমা নদী। বুধবার বিকেলে শহরের ষোলঘর পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৮৪ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপরে। ছাতক পয়েন্টেও বিপদসীমার উপরে।
এছাড়া কালনী, কুশিয়ারা, যাদুকাটা নদীসহ সব নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
জেলার ধর্মপাশা থেকে মধ্যনগর উপজেলাগামী একমাত্র পাকা সড়কটি এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। মধ্যনগর থেকে মহেষখলাগামী দোয়ারাবাজার এবং তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জগামী পৃথক ৩টি পাকা রাস্তায় যান চলাচল এখনও বন্ধ। জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার থেকে সুনামগঞ্জগামী রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় নৌকা চলাচল শুরু হয়েছে।
সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর থেকে ডলুরাগামী রাস্তাটির সৈয়দপুর পয়েন্টে ডুবে যাওয়ায় উত্তর সুরমা এলাকার সঙ্গে শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
এদিকে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। উজানের ঢলের সঙ্গে ভারী বৃষ্টি হলে পানি বাড়তে পারে।
এদিকে, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় সুরমা নদীতে নৌকা ডুবে নিখোঁজ মা-মেয়েসহ তিনজনের বুধবার রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া যায়নি। নদীতে স্রোত বেশি থাকায় উদ্ধারকাজে বেগ পেতে হচ্ছে। উপজেলা সদরে ত্রাণ দেওয়ার খবর পেয়ে নদী পার হয়ে সেখানে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে তাঁরা স্রোতে ভেসে যান।
নিখোঁজ তিনজন হলেন উপজেলার আজমপুর এলাকায় সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা গুলজান বেগম (৬৫), জোছনা বেগম (৩৫) ও তাঁর মেয়ে হাবিবা আক্তার (২)।
মৌলভীবাজারে ৩ উপজেলা প্লাবিত :
উজানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি ঢলের কারণে মৌলভীবাজারের তিন উপজেলা ফের প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় আবারও বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, রাজনগর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার তিন ইউনিয়নে পানি বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার রূপ নিয়েছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে কুলাউড়া পৌরসভার পাঁচ ওয়ার্ড, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ, জুড়ী উপজেলা পরিষদসহ ওইসব এলাকার বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তা ঘাট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বুধবার জানায়, মনু নদীর (রেলওয়ে ব্রিজ) পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ও মনু নদীর (চাঁদনীঘাট) পানি বিপদসীমার ৫০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর (রেলওয়ে ব্রিজ) পানি বিপদসীমার ১৬৮ সে.মি. ও কুশিয়ারা নদীর (শেরপুর) পানি বিপদসীমার ১৯ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপদসীমার ১৯০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জুড়ী নদীর (ভবানীপুর) পানি।
বৃষ্টিপাতের কারণে কুশিয়ারা, জুড়ী, ফানাই ও আন ফানাই নদী দিয়ে ঢল নেমে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘দীর্ঘস্থায়ী’ বন্যায় এসব এলাকার পানিবন্দি সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন তাদের বাড়ি ফেরা অনেকটা অনিশ্চিত।
ভারী বর্ষণ-উজানের ঢলে মৌলভীবাজারে মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদরের খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা এলাকায় কুশিয়ারার পানি উপচে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে জনপদে প্রবেশ করেছে। এ এলাকায় কুশিয়ারার স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নেই। গ্রামীণ সড়কটিই প্রতিরক্ষা বাঁধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নতুন করে ভাঙনের ফলে আশপাশের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি ভয়ের কারণ। কুশিয়ারায় পানি বাড়লে মনুর পানি কমবে না।