বন্যা অপরিবর্তিত, দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২৪, ৪:০০:২৩ অপরাহ্ন
*৩ জেলায় পানিবন্দী ১৫ লাখ মানুষ * পাঠদান বন্ধ প্রায় ৯শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে তৃতীয় দফার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। সুরমা কুশিয়ারার পানি কোথাও এক সেন্টিমিন্টার কমলেও অন্য পয়েন্টে বাড়ছে। এতে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন মানুষ।
বানের পানিতে গ্রাম থেকে নগর সবখানেই রাস্তা, পুকুর, ঘরবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়ে থমকে গেছে সবকিছু। পানিবন্দী অবস্থায় আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এছাড়া সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এতে মানুষের কষ্টের পাশাপাশি পড়ালেখাও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
বুধবার প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও সিলেট বিভাগের প্রায় হাজারও বিদ্যাপীঠে পাঠদান হয়নি। পাঠদান বন্ধ থাকা এসব বিদ্যাপীঠের অধিকাংশই এখনো পানির নিচে, আবার কোনো কোনোটি ব্যবহৃত হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৫ হাজার ৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮৮৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান হয়নি। সেসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশই এখনো পানিতে দলিয়ে আছে। একটা অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার গৃহহীনদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে।
এদিকে, বুধবার দুপুরের পর বৃষ্টি না হলেও সন্ধ্যা ও রাতে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। ৩টার পর প্রায় ঘন্টাব্যাপী ভারী বৃষ্টি হয়েছে। শেষ ২৪ ঘন্টায় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ৪২ মিলিমিটার। ফলে সিলেটের ওপর দিয়ে বয়ে চলা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৬টি পয়েন্টে বৃহস্পতিবারও বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা ও কুশিয়ারার সব কটি পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার, সিলেট পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে ১৫২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০৩ সেন্টিমিটার এবং শেরপুর পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। ধারাবাহিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে, ৬ পয়েন্টের মধ্যে তিনটি পয়েন্টে আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতীয় ঢলের পানি এখন নদীতে গিয়ে মিলছে। নদ-নদী পানিতে ভরা থাকায় নামতে বিলম্ব হচ্ছে।বন্যার এমন ভয়াবহতার মাঝেও সিলেট বিভাগে মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, বৃষ্টির পরিমাণ কমে এসেছে; এক/দুদিনের মধ্যে আরও কিছুটা কমবে। তবে বৃষ্টি থাকবে। এই বৃষ্টি হল, রোদ উঠল, আবার বৃষ্টি হল- এমন অবস্থা থাকবে।
এদিকে, বন্যায় সিলেটের ১৩টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি প্রথমেই আঘাত হানে। সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর মধ্যে জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বাঁধ উপচে ও বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়ে নতুন করে শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি যেমন ছিলো তেমনই আছে। বানের পানি স্থির হয়ে আছে। পানি কমা তো দূরের কথা, বরং কোথাও কোথাও বেড়েছে।
বিয়ানীবাজারের ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে তাদের গ্রামের ৮০ শতাংশ ঘর তলিয়ে গেছে। তৃতীয় দফার এ বন্যা গ্রামের প্রধান সড়কও ডুবিয়ে দিয়েছে।
কয়েক দিন আগেই পরিবারের আট সদস্য নিয়ে বন্যার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের মানাউরা গ্রামের বাসিন্দা এমাদ উদ্দিন। পানি কমে যাওয়ায় বাড়িও ফিরেছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করার আগেই আবার তৃতীয় দফায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। এমাদ বলেন, মানাউরা গ্রামের মূল সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বাসিন্দাদের মূল বাহন এখন নৌকা।
ফেঞ্চুগঞ্জের বিয়ালীবাজার এলাকায় বাসিন্দা শোয়েব আহমদ বলেন, ঈদের তৃতীয় দিন তাঁর ঘরে পানি উঠেছিল। এরপর ঘিলাছড়া এলাকায় এক বন্ধুর খালি বাড়িতে আশ্রয় নেন। এবারও ১ জুলাই রাতে পানি বেড়ে যাওয়ায় একই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এমন অবস্থা আরো অসংখ্যজনের।
জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ছবড়িয়া গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে যায়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা বস্তা ফেলে ডাইক মেরামত করেছিলেন। তবে সেটিও টেকেনি। গতকাল সকাল থেকে ডাইক ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকছে। এতে আশপাশের আরও চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়ি-ঘর ডুবে যাওয়ায় দিনমজুর মানুষগুলোর কোন কাজ নেই। তারা অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছেন।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ১ হাজার ১৬০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত এখনো। বন্যায় আক্রান্ত জনসংখ্যা ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৩ জন। গতকাল পর্যন্ত জেলায় ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার ২৩৪ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে, সিলেট নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন। অনেকেই আবার ঠাঁই নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে।
সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্ট বিপদসীমার উপরে থাকায় নগরের ভেতরে পানি প্রবেশ অব্যাহত আছে। নালা-ছড়া হয়ে উপশহর, শেখঘাট, কুশিঘাট, তালতলা, কাজীরবাজার, কলাপাড়া, মেন্দিবাগ, দক্ষিণ সুরমাসহ নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে পানি উঠেছে। একইসাথে নগরের শিবগঞ্জ, সোবহানীঘাট, যতরপুর, মীরাবাজার, শামীমাবাদ, মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা ও চৌকিদেখী এলাকাসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারাও পানিবন্দী অবস্থায় আছেন।
নগরের জামতলা এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, টানা বৃষ্টি হলেই মূল সড়কটি পানিতে ডুবে যায়। প্রতিবার সড়ক ডোবার সঙ্গে ঘরে ভেতরও পানি প্রবেশ করে। এক মাসের মধ্যে তার ঘরে অন্তত ছয় দফায় পানি প্রবেশ করেছে। প্রতিবার পানি ঢোকার পর ঘরের মালামাল সরাতে গিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধ ঘরের কারণে পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র অবস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। এসব নিয়ে বেশ ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার পড়েছেন।
সুনামগঞ্জে অপরিবর্তিত :
সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও হাওর এলাকায় পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এখনো রাস্তাঘাট তলিয়ে থাকায় সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নি¤œাঞ্চলে দুর্ভোগ কমছেনা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে পানি না নামায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। যাতায়াতের জন্য নৌকা ছাড়া কোন উপায় নেই।
পৌর শহরের কালীপুর, হাসননগর, পাঠানবাড়ি, বড়পাড়া, জলিলপুর, ওয়েজখালী এলাকার মানুষের বাড়িঘরে পানি আছে। সদর উপজেলার মনোহরপুর এলাকার বাসিন্দা মইনুল ইসলাম বলেন, পানি তো কমছে না। রাস্তাঘাটে এখনো পানি। চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছে।
গ্রামীণ সড়কের পানি থাকায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর সড়কে এখনো সরাসরি যান চলাচল বন্ধ আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমেছে। সকাল ৯টায় শহরের ষোলঘর পয়েন্ট সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে ২৫ মিলিমিটার। একই সময়ে সুনামগঞ্জের উজানের ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ৬৪ মিলিমিটার।জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৩১জন মানুষ বন্যাকবলিত।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেছেন, নদীর পানি কমেছে। হাওরেও পানি কমছে, তবে ধীরে। আগামী দুদিন হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে।
মৌলভীবাজারে কমছেনা হাওরের পানি :
পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোত কমে আসায় মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদের পানি বিপদসীমার নিচে নেমেছে। তবে কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাকালুকি হাওরের পানি কমছে না। জেলায় ৩ লাখের উপরে মানুষ পানিবন্দী আছেন।
ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে কয়েক দিন ধরে মনু, ধলাই, কুশিয়ারাসহ জেলার নদ-নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নদ-নদীতীরবর্তী গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর বৃষ্টি ও ঢলের পানি কিছুটা কমায় হাকালুকি হাওরের পানি কমেছিল। কিন্তু গত তিন-চার দিনের ভারী বর্ষণ ও ঢলে আবার আগের উচ্চতায় ফিরে এসে। পানি বাড়ায় হাকালুকি হাওরপারের মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় মনু নদের রেলওয়ে সেতুর কাছে বিপদসীমার ২৪০ সেন্টিমিটার ও মৌলভীবাজার শহরের কাছে চাঁদনীঘাটে ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। ধলাই নদ বিপদসীমার ২৭৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ও জুড়ী নদীর ভবানীপুরে ১৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের পানি কমছে না। চার-পাঁচ দিন আগে পানি কিছুটা কমেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরে নতুন করে পানি বেড়েছে। ফলে হাকালুকি হাওরপারের মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন, তারা সহসা বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না।