ঢাকা-দিল্লী উত্তেজনার প্রভাব সিলেট সীমান্তে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯:০৭:০২ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : বিতর্কিত ইসকন নেতা চিন্ময় দাস গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় অংশে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনের কতিপয় নেতাদের উস্কানীর পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় চলছে বিক্ষোভ। এমনকি এসব উগ্রপন্থীদের বাধায় সিলেটের ৩টি শুল্ক স্টেশনে কার্যত বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানী। গত ৩ দিন থেকে সবকটি স্টেশনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দুই দেশের আমদানি ও রপ্তানীকারকরা। পাশাপাশি শঙ্কায় রয়েছেন দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ।
তবে শঙ্কার বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও সকল সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা জানিয়েছে সিলেট বিজিবির শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার থেকে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় উগ্রপন্থী একটি সংগঠনের বাধায় সিলেটের জকিগঞ্জ, সুতারকান্দি ও জুড়ি শুল্কস্টেশন দিয়ে পণ্য বাংলাদেশ-ভারতে আমদানি-রপ্তানিসহ সবধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। কিছু স্টেশনে মাঝে মাঝে পাথর-কয়লা আমদানী হলেও রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, ভারতের শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) সীমান্তে সনাতনী ঐক্য মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের বিক্ষোভকারীরা সিলেটের জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন। সোমবার (২ ডিসেম্বর) সকালে কিছু কমলা বাংলাদেশে এলেও পরে আন্দোলনকারী সংগঠনটির বাধার মুখে আর কোনো পণ্য আসেনি। এর আগে সকালের দিকে জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জে) থেকে প্রায় ৬ টন কমলা বাংলাদেশে আমদানি হয়। পরে সেখানকার বিক্ষোভকারীরা আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। ফলে বাংলাদেশি আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের এলসি করা মালামালের গাড়ি ভারতের শ্রীভূমি শুল্ক স্টেশন থেকে ফেরত যায়। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন আমদানীকারকরা।
আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, ভারতের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) শুল্ক স্টেশনে সেখানকার বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের এলসি করা মালামালের গাড়ি ফেরত দিয়েছেন। এ নিয়ে জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন থেকে আমরা ভারতের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) শুল্ক স্টেশনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও সেখানকার কর্মকর্তারা কল রিসিভ করেননি। তবে সকালের দিকে প্রায় ৬ টন কমলা বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে। জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতে কোনো পণ্য দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি হয় না। সুতারকন্দি শুল্ক স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশি প্রাণ, আকিজসহ কয়েকটি কোম্পানির পণ্য ভারতে যায় বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
এ দিকে ভারতের শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) একটি সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকালের দিকে বাংলাদেশের সুতারকান্দি শুল্ক স্টেশন দিয়ে রপ্তানি হওয়া পটেটো, কেকসহ কিছু পণ্য সনাতনী ঐক্য মঞ্চের সদস্যরা করিমগঞ্জে পুড়িয়ে ফেলেছে। এমনকি বাংলাদেশি পণ্য বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য ভারতের উত্তর আসামের এমএলএ কমলাখ্যা দে পুরকায়স্থ শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) জেলা প্রশাসককে একটি চিঠিও দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সুতারকান্দি সীমান্ত এবং শ্রীভূমি স্টিমারঘাট হয়ে নদীপথে রপ্তানি ও আমদানি বন্ধ করার অনুরোধ করছি।
জানা গেছে, সিলেটের তামাবিল সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশে তেমন উত্তেজনা না থাকলেও রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। আমদানীর মধ্যে মাঝে মাঝে পাথর ও কয়লার ট্রাক আসছে বলে তামাবিল শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ না হলেও নাম মাত্র পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
এব্যাপারে তামাবিল স্থল বন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, তামাবিল স্টেশনের ভারতীয় অংশ থেকে কোন জটিলতার খবর পাইনি। তবে আমদানী একেবারে কমে গেছে। মাঝে মাঝে পাথর ও কয়লার ট্রাক দেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ থেকেও তেমন পন্য রপ্তানি হচ্ছেনা বলেও জানান তিনি।
সীমান্ত এলাকায় কোন শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ হাফিজুর রহমান। তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমার আওতাধিন সীমান্ত এলাকায় কোন শঙ্কা নেই। এরপরও পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার থেকে সুতারকান্দি ও জুড়ি স্টেশন দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। রোববার বিয়ানীবাজারের শেওলা শুল্কস্টেশনের ওপারে ভারত অংশের সুতারকান্দি শুল্কস্টেশন এলাকায় সনাতনী ঐক্যমঞ্চ ‘বাংলাদেশ চলো’ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এসময় আন্দোলনকারীরা আসাম পুলিশ ও বিএসএফের ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢোকার চেষ্টা চালায়। পরে অবশ্য পরিস্থিতি শান্ত হয়। সেসময় আন্দোলনকারীরা সুতারকান্দি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের দাবিও তোলেন।
শেওলা স্থল বন্দরের ইনচার্জ হাসান আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবারও শেওলা সীমান্ত পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল। আমাদের এদিক থেকে কোন সমস্যা না নেই। কিন্তু আমদানি-রপ্তানীকারকরা নিজে থেকেই কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিজিবি ৫২’র অধিনায়ক লে. কর্ণেল মেহেদী হাসান দৈনিক জালালাবাদকে জানান, সুতারকান্দি সীমান্তে ভারতের আভ্যন্তরে কিছুটা গন্ডগোল হয়েছে। যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। সেটা ভারত সরকার নিজেরাই কন্ট্রোল করেছে। আমরা আমাদের সীমান্তে সবসময় সতর্ক থাকি। এরপরও বর্তমান পরিপাশির্^ক অবস্থা বিবেচনায় সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। কোন কিছু ঘটলে যাতে আগে জানতে পারি সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় এলাকাবাসীদেরকে আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।
এদিকে- ভারতীয়দের বিক্ষোভ নিয়ে একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হলে বিষয়টি সবার নজরে আসে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের আটকাতে কাটাতারের বেঁড়া ব্যবহার করে ভারতীয় আইনশৃংখলা বাহিনী। এতে বেশকিছু ভারতীয় উগ্রপন্থী নাগরিক অংশ নেন। হিন্দু ঐক্যমঞ্চ নামের একটি সংগঠনের নামে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। ভারতীয়দের এমন আগ্রাসন সহজভাবে নিচ্ছেন না সীমান্তঘেঁষা এলাকার বাসিন্দারা। অনেকেই তাদের আতঙ্কের বিষয়টি জানিয়েছেন। যদিও বিজিবির সবকটি সেক্টরের কর্মকর্তাবৃন্দ সাধারণ জনগণকে আশ^স্ত করতে কাজ করছেন। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।