নির্মল সিলেটেও বাড়ছে বায়ুদূষণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩:০১:২৬ অপরাহ্ন
নভেম্বরে গড় বায়ুমান সূচক ছিলো ১০৪
জালালাবাদ রিপোর্ট: নির্মল শহর হিসেবেই পরিচিত সিলেট। এখানে যেমন রয়েছে হাওর-বাওর, নদ-নদী- তেমনি আছে চা বাগান আর সবুজ অরণ্য। বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে অন্য এলাকার তুলনায় সিলেটে বিশুদ্ধ বায়ু রয়েছে। তবুও দিন যত যাচ্ছে, সিলেটে বায়ুদূষণ ততই বাড়ছে।
দূষণ পরিমাপের একটি একক হচ্ছে অ্যারোসল অপটিক্যাল ডেপথ (এওডি)। এওডির মধ্যে আছে ধুলাবালু, জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়া উপাদান, কলকারখানার ধোঁয়াসহ নানা উপাদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ কৃত্রিম উপগ্রহের সহায়তায় সিলেটসহ দেশের ৬টি শহরের অ্যারোসল অপটিক্যাল ডেপথ (এওডি) গবেষণা করে। এই গবেষণায় এক দশকের বায়ুদূষণের প্রবণতা দেখার চেষ্টা করা হয়। গবেষণাটি অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ৬ শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ এওডি মান ছিল রাজশাহী, শূন্য দশমিক ৭৮। আর এরপর ছিল খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম।
গত নভেম্বরে সিলেট বিভাগীয় শহরের গড় বায়ুমান সূচক বা একিউআই ছিলো ১০৪। এছাড়া দেশের ১২ শহরের মধ্যে অন্যশহরগুলোর বায়ুমান হলো- ঢাকা ১৯৫, গাজীপুর ১৯১, নারায়নগঞ্জ ২০৫, নরসিংদী ১৭৫, সাভার ১৯০, রাজশাহী ১৭৯, খুলনা ১৫৯, বরিশাল ৮৯, কুমিল্লা ১৩৯, ময়মনসিংহ ১৬৭, রংপুর ১৮৬। পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবারও সিলেট নগরের গড় বায়ুমান সূচক বা একিউআই ছিলো ১২০। হিসেব অনুযায়ী এই স্কোর অস্বাস্থ্যকর।
২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায়ও দেখা যায়, সিলেট বিভাগ, যেখানে দেশের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ু রয়েছে। এখানেও ডব্লিউএইচও নির্দেশিত দূষণ ঘনত্বের মাত্রা ৮০ শতাংশ বেশি অনুভব করে। এটির ক্ষতি প্রতিদিন ১২ টি সিগারেট খাওয়ার সমান।
পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র নির্মাণকাজ, যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়া- বায়ুদূষণের জন্য এই নিয়ামকগুলোই দায়ী। এসব উৎস বন্ধে কড়া পর্যবেক্ষণ দরকার। আর দরকার মানুষকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা। এসব করার কথা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকা- নেই বললেই চলে।
গবেষক ও বুয়েটের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক শাহিদ উজ জামান বলেন, এওডির উচ্চমান প্রমাণ করে যে দেশের প্রায় সব বড় শহরে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। এই শুষ্ক মৌসুমে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশের বায়ুদূষণে প্রভাব ফেলে, এটা ঠিক। কিন্তু এর পাশাপাশি নির্মাণকাজের ধূলিকণা, ইটভাটা এবং যানবাহনের দূষিত ধোঁয়ার মতো উৎসগুলোও দূষণ ঘটায়। এসব উৎস নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত।
গত নভেম্বরে ঢাকা নগরীতে বায়ুদূষণ ছিল গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বায়ুর এ মান পর্যবেক্ষণ করে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আট বছর (২০১৬-২০২৩) নভেম্বর মাসে ঢাকার বায়ুমান সূচক বা একিউআই ছিল ১৭৬ দশমিক ৬৬। এ বছরের নভেম্বরে এ মান ১৯৫। অর্থাৎ এবার নভেম্বর মাসে বায়ুর গড় মান গত ৯ বছরের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আর ২০২৩ সালের তুলনায় বায়ুমান সূচক ১১ দশমিক ৫ ভাগ বেড়ে গেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, গেল নভেম্বরে ঢাকার মানুষ এক দিনও ভালো বা নির্মল বায়ুতে নি:শ্বাস নিতে পারেনি। নভেম্বরে এক দিন বায়ুমান ছিল ‘মধ্যম’ প্রকৃতির। চার দিন বায়ুমান ছিল ‘সতর্কতামূলক’। ১২ দিনের বায়ুমান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ আর ১৩ দিনের বায়ুমান ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার বায়ুর মান মাঝেমধ্যে অস্বাস্থ্যকর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ঘরের বাইরে গেলে সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংবেদনশীল ব্যক্তিদের অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, কোনো এলাকায় টানা তিন দিন তিন ঘণ্টা ধরে একটানা বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকলে সেই এলাকায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত। ঢাকায় এখন যে অবস্থা, তাতে অবশ্যই জনসাধারণকে অন্তত জরুরি বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিন্দুমাত্র কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।