সিলেটে জ্বালানি তেলের সংকট
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১০:৫২ অপরাহ্ন
সরবরাহ চাহিদার অর্ধেকের কম
এমজেএইচ জামিল: সিলেটের পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদার অর্ধেক তেল পাচ্ছেন না পাম্প মালিকগণ। ফলে সিলেটের পাম্পগুলোতে গ্রাহক দুর্ভোগ সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন অনেকে। সিলেটে দৈনিক ১০ লাখ লিটার জ¦ালানি তেলের চাহিদা থাকলেও সপ্তাহে মিলছে ৮ লাখ লিটারেরও কম। বোরো মওসুমে জ¦ালানি তেলের সংকটে বিপাকে মালিক ও ক্রেতাসাধারণ।
জানা গেছে, সিলেটে জ্বালানি তেল আসে চট্টগ্রাম থেকে। ট্রেনে ওয়াগনে করে সিলেটে নিয়ে আসা হয় জ্বালানি। এরপর ডিপো থেকে সংগ্রহ করে পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশনের ব্যবসায়ীরা বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন সিলেটে ১০ লাখ লিটার জ্বালানির দরকার, সেখানে দুইদিন পরপর দুই থেকে আড়াই লাখ লিটার তেল পান ব্যবসায়ীরা। ৪ বছর থেকে সিলেট ফিল্ডের কৈলাশটিলা থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ। এই অবস্থায় সংকট কাটাতে সিলেটের ভৈরব ও আশুগঞ্জ থেকে তেল নিয়ে আসেন। এতে লাভ হচ্ছে না, উল্টো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
সিলেট বিভাগ পেট্রল পাম্প অ্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় ১১৪টি পেট্রল পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলা ও নগরীতে পাম্প আছে ৬০টি। এসব পাম্পে প্রতিদিন পেট্রল, অকটেন ও ডিজেলের চাহিদা ১০ লাখ লিটারেরও বেশি।
জানা গেছে, সবকটি পেট্রল পাম্পে চট্টগ্রাম থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা হয়। সিলেটের তেল সরবরাহ ওয়াগন নির্ভর। তাই ওয়াগন সংকটের কারণে প্রায়ই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় পাম্পগুলোকে। সর্বোপরি সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন ৪ বছর থেকে বন্ধ থাকায় এ সংকট হচ্ছে দিন দিন তীব্রতর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেলের মান ভালো নয় জানিয়ে, গত ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানী তেল উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে সিলেটের গ্যাসফিল্ড থেকে উৎপাদিত পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন ক্রয় বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সিলেট গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাসের সাথে উত্তোলিত কনডেনসেট বিপিসি ক্রয় না করায় এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় গোলাপগঞ্জের আরপিজিসিএল ও এলপিজি প্লান্ট। এছাড়া, তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোলাপগঞ্জ কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড থেকে উত্তোলিত অতি উচ্চ মানের এনজিএল (ন্যাচারাল গ্যাস লিকুইড) পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ব্যারেল (১৫ লক্ষ ৯০ হাজার লিটার) কনডেনসেট উত্তোলিত হয়। এর মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগের গ্যাস ফিল্ড গুলোতে থেকে উত্তোলিত হতো প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ব্যারেল এবং বাকি ৫শ’ ব্যারেল উৎপাদিত হয় দেশের অন্য গ্যাস ক্ষেত্র গুলোতে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে ৭ হাজার ৭শ ৬১ ব্যারেল, সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ড থেকে ১ হাজার ব্যারেল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন হরিপুর এবং কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ড গোলাপগঞ্জ থেকে উৎপাদিত হয় ৭৩০ ব্যারেল কনডেনসেট।
জানা গেছে, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আওতাধীন গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে প্রতিদিন ৩শ’ ব্যারেল কনডেনসেট থেকে জ¦ালানী তেল উৎপাদন ক্ষমতার ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট আছে। এছাড়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডে ৩ হাজার ৮শ’ ব্যারেলের ফ্রাকশনেশন প্লান্টসহ প্রতিটি গ্যাস ফিন্ডে ছোট আকারের ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট রয়েছে। অবশিষ্ট কনডেনসেট দেয়া হতো দেশের অন্যান্য স্থানের সরকারি ও বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্লান্টগুলোকে। ২০২১ সালে ৬ মাসেরও অধিক সময় থেকে বিপিসি তেল না নেয়ায় সিলেটসহ দেশের ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং সব কনডেনসেট দেয়া হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সিলেটে বিগত ৪ বছর ধরে জ্বালানি তেল সংকটের বিষয়টি তীব্র হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, আগে নিয়মিত তেল সরবাহ ছিল। ফলে সংকট হতো না। কিন্তু এখন নিয়মিত তেল আসে না। এ কারণে সংকট হচ্ছে।
পেট্রোল পাম্প ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শীত মৌসুমে বোরো চাষের জন্য সেচের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ ডিজেলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই মৌসুমে সংকট দেখা দেয়ায় সেচে ব্যবহৃত জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরাদের উদ্যোগে সিলেটের বাইরে আশুগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল থেকে তেল আনা হচ্ছে। এতে দাম বেশি পড়ছে। তবু সংকট কাটানো সম্ভব হচ্ছে না।
সিলেটের জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে রেলের ওয়াগনের মাধ্যমে সিলেটে তেল আসে। নানা কারণে রেলের ওয়াগন চলাচল অনিয়মিত হয়ে পড়া ও কোনো কোনো দিন বন্ধ থাকায় বর্তমানে সিলেটের অধিকাংশ পাম্প রয়েছে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বন্ধ না হলে এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠা যেতো বলে ব্যবসায়ীদের মতামত।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় তেল বিপণন কোম্পানী যমুনা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড এর পরিচালক (স্বাধীন) সালেহ আহমদ খসরু দৈনিক জালালাবাদ বলেন, সিলেটের পাম্পগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ সংকটের সত্যতা আমি পেয়েছি। আজ (বৃহস্পতিবার) কোম্পানীর ১ম বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। আমি উক্ত মিটিংয়ে সিলেটের জ¦ালানি তেল সংকটের বিষয়টি উত্থাপন করবো এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংকট সমাধানে জোরালো ভুমিকা পালন করবো।
তিনি বলেন, অতীতে ফ্যাসিস্ট সরকার সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিগত সময়ে সিলেট অঞ্চলের জন্য শেরপুরে একটি ডিপো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর কাজ বসুন্ধরা গ্রুপকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আগামী দিনে সেটি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবো। আমি অধিকার আদায়ে রাজপথে চিৎকার করেছি এবার সিলেটের ব্যবসায়ীদের অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেও চিৎকার করবো।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস ডিস্ট্রিবিউটরস এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি জুবায়ের আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ডিজেল সরবরাহ ওয়াগন নির্ভর হওয়ায় আমাদেরকে প্রায়ই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। সর্বোপরি সিলেটের গ্যাস ফিল্ডসমূহের খনি থেকে উত্তোলিত কনডেনসেট থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বন্ধ থাকায় এ সংকট কাটিয়ে উঠা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ৩টি তেল বিপণন কোম্পানী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। কোন কোম্পানী চাহিদামতো জ¦ালানী তেল সরবরাহ করতে পারছেনা। যাদের চাহিদা বেশী সেসব পাম্প মালিকদেরকে ভৈরব থেকে জ¦ালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে। অথচ আমরা আগে সিলেটে বসেই চাহিদামতো তেল পেতাম। এখন অনিয়মিত ও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি।