অবশেষে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি : রক্তাক্ত সংঘাতে জিতল কে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০২৫, ১১:৫৯:১৫ অপরাহ্ন
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি চালু হবে ফের
জালালাবাদ প্রতিবেদন : দীর্ঘ ১২ দিন ধরে চলা ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘাতের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৈরী দেশ ইরান ও ইহুদিবাদি ইসরায়েল। প্রাণহানি, অবকাঠামোগত ধ্বংস এবং চরম উত্তেজনার পর এই যুদ্ধবিরতিকে অঞ্চলটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। আর এ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আল উদেইদে ইরানের নজিরবিহীন হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হচ্ছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জবাবে ইরানের পাল্টা আক্রমণে কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হননি।
যুদ্ধবিরতির পর ইরান, ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি দেশই নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে,
১২ দিনের এ যুদ্ধে আসলে কে জিতেছে?
সোমবার সকালে ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক করে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা হামলার বিষয়ে আলোচনা হয়। আগের সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতা ও অবকাঠামোর ওপর ভয়াবহ হামলা চালায়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে। এতে ইরান বড় ধাক্কা খায়।
ইরান মর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছিল। এক বাংকার থেকে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পাল্টা হামলার নির্দেশ দেন। এ তথ্য জানিয়েছেন যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত চার ইরানি কর্মকর্তা। তবে খামেনি নির্দেশ দেন, হামলা সীমিত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে হবে।
ইরান চেয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কোনো মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও হামলা করতে উসকে দিতে চায়নি। ফলে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটি বেছে নেয়।
দুই গার্ড সদস্যের মতে, এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি। তাঁরা মনে করেন, এখান থেকেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সমন্বয় করা হয়েছিল। কাতার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় ইরান আশা করেছিল, হামলায় ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।
হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠায়। কাতার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রও আগাম সতর্কবার্তা পায়। জনসাধারণের উদ্দেশে ইরান বলে, এই হামলা ইরানের ওপর আঘাতের পাল্টা শোধ।
টিভিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র বলেন, কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে বিপ্লবী গার্ড বাহিনী হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের শত্রুদের সতর্ক করছি। পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার যুগ শেষ। আক্রমণের সময় ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি দেশাত্মবোধক গান বাজায়। কাতারের আকাশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ঝলক দেখানো হয়। উপস্থাপকেরা ইরানের গৌরব ও বিজয়ের কথা বলেন।
এক ইরানি কর্মকর্তা জানান, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার সময়ই পরিকল্পনা ছিল, কোনো মার্কিন নাগরিক যেন নিহত না হন। কারণ, কোনো মৃত্যু হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা আঘাত হানতে পারত। পরিকল্পনা কার্যকর হলো। ট্রাম্প জানান, ১৪টি ইরানি মিসাইলের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত হয়েছে। কেউ নিহত বা আহত হননি। ক্ষয়ক্ষতিও কম।
কিন্তু পর্দার আড়ালে ইরানের শীর্ষ নেতারা আশা করেছিলেন, তাঁদের সীমিত আক্রমণ আর আগাম সতর্কতা ট্রাম্পকে পিছু হটতে রাজি করাবে। ইরানও তখন পিছিয়ে আসবে।
অভূতপূর্বভাবে ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, আমাদের আগাম সতর্ক করায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। এরপর ইরানে বোমা ফেলতে ইসরায়েলকে নিষেধ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ইরান তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আশা করি আর কোনো ঘৃণার কাজ হবে না। ট্রাম্প জানান, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি শিগগিরই হবে। কিছুক্ষণ পর ইরানও যুদ্ধবিরতির কথা জানায়। ইসরায়েলও যুদ্ধবিরতির কথা জানায়। তারা জানায়, ইরানি মিসাইল হামলায় তাদের আরও চারজন নিহত হয়েছে।
এরপর আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ইসরায়েলকে সতর্ক করে লিখেন, ইসরায়েল, ওই বোমাগুলো ফেলো না। তুমি যদি এটা করো, তা হবে (যুদ্ধবিরতির) বড় ধরনের লঙ্ঘন। পাইলটদের এখনই ঘরে ফেরাও!
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, এখন সবাই নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে। বড় যুদ্ধ এড়াতে পেরেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলছে, তারা আঞ্চলিক শত্রু ইরানকে দুর্বল করেছে। আর ইরান বলছে, তারা টিকে আছে এবং শক্তিশালী শত্রুদের পাল্টা জবাব দিয়েছে।
এক সপ্তাহের কম সময়ে যুদ্ধের তীব্রতা সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু ইরান আর দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চায় না। বেশির ভাগ ইরানি এখন দেশের পক্ষে একজোট হয়েছেন। এই যুদ্ধকে তাঁরা মাতৃভূমির ওপর হামলা বলেই বিবেচনা করেছেন। তবে লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। দোকানপাট, ব্যবসা ও সরকারি অফিস বন্ধ বা সীমিত সময় চালু ছিল। সেখানে অর্থনৈতিক চাপ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
এদিকে পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা সত্ত্বেও ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ইরান কি আরও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাবে, নাকি গোপনে অন্য কোনো আক্রমণ করবে? নাকি কঠিন নিষেধাজ্ঞা শিথিলের জন্য আলোচনায় বসবে?
রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মাইস কুরবানভ আল-জাজিরাকে বলেছেন, ইরানে হামলা চালিয়ে দখলদার ইসরাইল ‘বড় ভুল করেছে’। এর মধ্যদিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, তা হলো- ইসরাইলের অন্য সব উসকানিমূলক পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা তাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ইহুদিবাদী ইসরাইলকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার টেলিভিশনে প্রচারিত বার্তার কথা উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইরান ইহুদিবাদী ইসরাইলের হামলার কড়া জবাব দিয়েছে। আমি মনে করি, ইরানই এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি চালু হবে ফের :
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে কী কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এখন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনা চলছে। মঙ্গলবার এমনটাই জানালেন ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মুহম্মদ ইসলামি। ইরান দাবি করেছিল, ইসরায়েল বা আমেরিকার হামলায় তাদের পরমাণু কেন্দ্রের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণও হচ্ছে না। এ বার তারা তাদের পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু করারই ইঙ্গিত দিয়ে রাখল, যা নিয়ে এই সংঘাতের সূত্রপাত। তারা এ-ও স্পষ্ট করল যে, এই কর্মসূচিতে কোনও বাধা এলে তা প্রতিহতও করবে তারা।
ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান ইসলামির বিবৃতি প্রকাশ করেছে ইরানের সংবাদ মাধ্যম মেহর নিউজ। মুহম্মদ ইসলামি বলেন, আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছি। যে এলাকাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখন সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, পরমাণু কর্মসূচি চালু করার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
হঠাৎ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসরায়েলের :
এদিকে হঠাৎ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, ইরান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এর জবাবে তেহরানের কেন্দ্রে ইরানের সরকারি স্থাপনায় জোরালো হামলা করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
তবে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পর ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইরান। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদুলরহিম মুসাভি দাবি করেছেন, গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেহরান ইসরায়েলের দিকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েনি।
ইসরায়েলের হামলায় ৬১০ জন নিহত:
ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইরানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬১০ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তেহরান।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসেইন কেরমানপুর মঙ্গলবার এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া পোস্টে এ তথ্য জানান বলে এএফপির খবরে বলা হয়। তিনি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭০০’র বেশি মানুষ।
হোসেইন কেরমানপুর বলেন, ‘গত ১২ দিনে আমাদের হাসপাতালগুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
ইসরায়েলের বিষয়ে ‘খুশি নন’ ট্রাম্প :
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের বিষয়ে একেবারেই ‘খুশি নন’।
ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমার ধারণা নির্ধারিত সময়ের পরে একটি রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েল এখন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এদের শান্ত হওয়া উচিত। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চুক্তি করার পরপরই ইসরায়েল যা করেছে তা আমার পছন্দ হয়নি। তাদের (ক্ষেপণাস্ত্র) নিক্ষেপ করা উচিত হয়নি।