যুদ্ধবিরতি কি যুদ্ধের অবসান?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৫, ১১:৫০:০৪ অপরাহ্ন
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী ধ্বংস হয়নি, পিছিয়েছে মাত্র
জালালাবাদ রিপোর্ট : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সন্ধ্যায় ঘোষণা করেছেন যে ইসরায়েল ও ইরান একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এটি একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইরানে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর, ইরানও প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে মিসাইল হামলা শুরু করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় বোমা হামলা করে। প্রায় ১২ দিন ধরে চলা সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে দুই দেশ।
ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি তাদের আক্রমণ বন্ধ করে দেয়, তবে তারা গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরায়েল বলেছে, ইরানে তাদের আক্রমণের “উদ্দেশ্য অর্জন” হয়েছে, তাই তারা এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে।
তবে যুদ্ধবিরতি আদৌ টেকসই হবে কি না- তা নিয়ে ইতিমধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েল এবং ইরান উভয়ই এটি লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য ট্রাম্প এ-ও বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই সমানভাবে যুদ্ধ বন্ধ চেয়েছিলো।
যদি যুদ্ধবিরতি বহাল থাকে, তাহলে আশা করা হচ্ছে যে, এটি একটি স্থায়ী শান্তিতে রূপ লাভ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রচুর দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে।
এদিকে দুই দেশ যখন যুদ্ধবিরতিতে গেছে, তখন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত-সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন করেছে ইরানের পার্লামেন্ট। বুধবার বিলটি অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ।
বিলটিকে আইনে পরিণত করতে ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে। বিলে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আইএইএ যদি ইরানের কোনো পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে চায়, সেক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে।
চলতি সপ্তাহে ইরানের পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি বিলটির সাধারণ কাঠামো অনুমোদন করেছে। কমিটির মুখপাত্র জানান, এই বিল কার্যকর হলে ইরানে নজরদারি ক্যামেরা স্থাপন, পরিদর্শন এবং আইএইএর কাছে প্রতিবেদন দাখিল স্থগিত করা হবে। এতে উত্তেজনা নতুন করে বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি, কয়েক মাস পিছিয়েছে মাত্র :
ইরানের দুটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগুলোর প্রবেশপথ বন্ধ করে দিতে পেরেছে। কিন্তু স্থাপনার ভূগর্ভস্থ ভবনগুলো ধ্বংস করতে পারেনি।
একটি প্রাথমিক গোপন মার্কিন প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি অবগত আছেন-এমন কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা এ খবর জানিয়েছেন।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহান্তের হামলায় (ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় সময় গত শনিবার সন্ধ্যা) ইরানের পরমাণু কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাসের জন্য পিছিয়েছে।
হামলার আগেই মার্কিন গোয়েন্দারা বলেছিলেন, ইরান দ্রুত (পারমাণবিক) বোমা তৈরির চেষ্টা করলেও তাতে অন্তত তিন মাস লাগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা ও ইসরায়েলের বিমানবাহিনীর কয়েক দিনের হামলা শেষে মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) ধারণা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অগ্রগতি শুধু ছয় মাসের কম সময়ই পিছিয়েছে।
সাবেক কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ইরান যদি তড়িঘড়ি পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করে, তবে তা হবে অপেক্ষাকৃত ছোট ও অপরিপক্ব ধাঁচের বিস্ফোরক ডিভাইস। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির (আকারে ছোট হলেও অত্যন্ত বিধ্বংসী) পারমাণবিক বোমা তৈরি করা অনেক বেশি জটিল কাজ। কিন্তু মার্কিন হামলায় ইরানের উন্নত মানের পারমাণবিক গবেষণায় কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক মূল্যায়ন আমলে নিলে বলতে হয়, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হামলার আগেই ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ সরিয়ে ফেলে। এতে হামলায় পারমাণবিক উপাদানের খুব সামান্যই ধ্বংস হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউরেনিয়ামের কিছু অংশ ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইরানের ওপর আরেকটি হামলার সম্ভাবনা কতটা :
ইসরায়েল ও ইরান শুধু যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, শান্তিচুক্তি হয়নি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ভবিষ্যতে দুটি সম্ভাব্য পথ খোলা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথমত, আবারও আইএইএর তত্ত্বাবধানে পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা এবং একটি নতুন চুক্তি করা; যেমনটা ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় হয়েছিল (জেসিপিওএ)। যদিও সেই চুক্তি থেকে ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্রই একতরফা বেরিয়ে গিয়েছিল (ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে)। এমন চুক্তি করা হলে তেহরানের ওপর তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ কমবে।
এ প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে ২০ জুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কাল্লাসও। তিনি মার্কিন হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদিও একা ইরানকে আপোসে রাজি করাতে সক্ষম নয়, তবু সংস্থাটি মার্কিন-ইসরায়েলি কড়া অবস্থানের বিপরীতে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে পারে।
এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূরাজনীতির শিক্ষক ইয়োআনিস কোটুলাস বলেন, ইরান কূটনৈতিকভাবে ইউরোপকে জড়ানোর চেষ্টা করবে, সেটি আরও বেশি তত্ত্বাবধানের প্রস্তাব দিয়ে (পারমাণবিক কর্মসূচিতে) এবং এ কর্মসূচির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি মেনে নিতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও ইতিমধ্যে তা বলেছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরকার পতনের চেষ্টা চালাবে, এ সম্ভাবনা কম। এখন ইরানের একমাত্র ভরসা ইউরোপ। রাশিয়া অবিশ্বস্ত।
তবে ইসরায়েল অতীতে ইরান ও পশ্চিমাদের মধ্যে যেকোনো পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার চেষ্টা করেছে। নতুন চুক্তিকেও তারা মেনে নেবে না বলেই মনে হয়।
উপরন্তু, ইরান কি চুক্তির পথে হাঁটবে? যখন যুক্তরাষ্ট্র আগের চুক্তি ভেঙে দিয়েছে, পরে আলোচনার শর্তও বদলে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত আলোচনা চলার সময়ই ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েছে?
অবশ্য এখন পর্যন্ত ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। অন্যদিকে ট্রাম্প সামাজিকমাধ্যমে আবারও জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তিনি আবার চালু হতে দেবেন না।
এই মৌলিক দ্বন্দ্ব যদি রয়ে যায়, তাহলে সামনে আবারও পাল্টাপাল্টি হামলা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সময়ের ব্যাপার মাত্র।