তুরাব হত্যা: কিছু প্রশ্ন এবং বাস্তবতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩:৩০:৪০ অপরাহ্ন
কবীর আহমদ সোহেল:
৮০ এবং ৯০ দশকে আল্লামা সাঈদীর তাফসীর শুনতাম নিয়মিত। বিশেষ করে সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠের তাফসীর মাহফিল মিস হয়েছে এমন ঘটনা নেই। সেই স্কুলজীবন থেকেই। সাঈদী (রা.) প্রতিটি তাফসীর মাহফিল শেষে হৃদয়কাড়া মোনাজাত করতেন। প্রত্যেক মোনাজাতেই তিনি শাহাদাতের তামান্না পেশ করতেন। বলতেন, আল্লাহ মৃত্যু যখন দিবা, শাহাদাতের মৃত্যু দিও।
আমার মনে প্রশ্ন জাগতো যুদ্ধ জিহাদ কিছু নেই। কাফির মুশরিকের সাথে কোনো সম্মুখ সমর নেই। এখানে শাহাদাতের সুযোগ কোথায়? মনের ভেতর এমন প্রশ্ন নিয়ে ভাবতাম। কয়েকবার ইচ্ছে হয়েছিল সরাসরি সাঈদী সাহেবের কাছ থেকে জেনে নেই। তখন সাহস করতে পারিনি।
সময়ের ব্যবধানে আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। সর্বশেষ সহকর্মী সাংবাদিক এটিএম তুরাবের শাহাদাত আমার মনের ভেতরের প্রশ্নের জবাব দিল অকাট্য দলিল প্রমাণসহ। মহান মাবুদ যদি তাঁর গোলামের শহীদী মৃত্যুর তামান্না আশা আকাঙ্খা কবুল করে নেন। তাহলে সেটা যেকোনো ভাবেই বাস্তবায়ন হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, মৃত্যু এক অবধারিত সত্য। তার ফায়সালা পৃথিবীতে আসার আগেই হয়ে যায়। কার কখন কীভাবে কোথায় মৃত্যু হবে তা থেকে এক চুল পরিমাণও এদিক সেদিক হবেনা।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বাদ জুম’আ সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্টের অনতিদূরে তুরাবকে নির্মমভাবে গুলি করে পুলিশ। প্রকাশ্যে দিবালোকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নিরপরাধ একজন সাংবাদিককে হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন। গুলিবিদ্ধ হবার প্রায় ৪ ঘন্টা পর শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পৃথিবী ত্যাগ করেন তরুণ সম্ভাবনাময় এই গণমাধ্যম কর্মী। আল্লাহপাক তুরাবকে শহীদের মর্যাদা দান করুন। তার পরকালীন জিন্দেগী শান্তিময় করুন।
এটিএম তুরাব। বয়সে ছোটো। পেশায় জুনিয়র। সঙ্গত কারণে বিদ্যমান আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতার মাঝে একটা ব্যবধান ছিল। কিন্তু তুরাব পরিবারের সাথে হৃদ্যতা গভীর এবং দীর্ঘদিনের। এ সম্পর্ক মূলত: তুরাবের বাবা মাস্টার আব্দুর রহিমের বদৌলতে। বড়লেখা পিসি হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালে আমরা তাকে চিনতাম। ‘রহিম স্যার’- খ্যাত এই ভদ্রজন ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ইসলামী আদর্শের সম্মুখ সারির ব্যক্তিত্ব। একারণেই শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার অকৃত্রিম সম্পর্ক তুরাব পরিবারের সাথে।
তুরাবকে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে। তার প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। ভিডিও ফুটেজ আছে। এতে সন্দেহ সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
প্রশ্ন হলো, পুলিশ অফিসার গোলাম দস্তগীরসহ জড়িত পুলিশের কেউ তো মস্তিষ্ক বিকৃত ছিল না। কারো সাথে তুরাবের কোনো দ্বন্দ্ব বিরোধ ছিল না। তুরাব কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীও ছিল না। ঘটনাস্থলের পরিস্থিতিও গুলি চালানোর মতো উত্তপ্ত ছিল না। প্রেস লেখা জ্যাকেট পরিহিত ছিল তুরাব। এই অবস্থায় তাকে গুলি করা হলো কেন?
এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। ১৭, ১৮ জুলাই সিলেট নগরীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র মিছিল, ১৮ জুলাই নগরভবনে সশস্ত্র যুবলীগ ক্যাডারদের নিয়ে তৎকালীন মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের গোপন বৈঠকে কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল?
পুলিশের তৎকালীন কর্মকর্তা আজবাহার আলী শেখ তৎকালীন শাসকদলের সাথে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ (মেয়র গ্রুপ), যুবলীগ, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় তুরাবকে হত্যা করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। ওসমানী হাসপাতালে তুরাবকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। নার্স ব্রাদাররা তার প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে মুমূর্ষু তুরাবকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তুরাবের মৃত্যু ঘটে। ওসমানী হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হলে হয়তো তুরাবকে বাঁচানো যেত। চিকিৎসায় অবহেলার জন্য ওসমানী হাসপাতালের তখনকার কর্মকর্তারা কী দায়ী নস?
শুধু কী তাই? তুরাবের পোস্টমর্টেম করতে প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা, লাশ গুম করার অপতৎপরতা, জানাজা দাফনে পর্যন্ত বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব প্রমাণ করে তুরাব হত্যা একটি পরিকল্পিত মানবতা বিরোধী অপরাধ। তুরাব হত্যামামলার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তুরাব হত্যা মামলার বিচার হোক। এটাই আজকের দাবি।