যেভাবে নিহত হন সাংবাদিক এটিএম তুরাব
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩:৩৬:৫৬ অপরাহ্ন
হুমায়ুন কবির লিটন:
সিলেটে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই জুমআ’র অন্য সব দিনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিল। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সিলেটসহ সারাদেশে তখন ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলন সরকার পতনের দিকে এগুচ্ছিল। সেই দিন জুমআ’র নামাজের প্রস্ততি নিয়েই তুরাব পেশাগত দায়িত্ব পালনে ঘর থেকে বের হন। প্রথমে শাবিপ্রবিতে যাওয়ার কথা থাকলেও অন্য এক সহকর্মীরা পরামর্শে তুরাব কোর্ট পয়েন্টে চলে আসে।
চলমান আন্দোলনের সমর্থনে জুমআ’র নামাজের পর সিলেট কালেক্টরেট মসজিদ থেকে বিএনপি-জামায়াত-ছাত্র-জনতার একটি মিছিল জিন্দাবাজারের দিকে যাচ্ছিল। মিছিল শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ বেপরোয়া গুলি শুরু করে। অন্য সাংবাদিক সহকর্মীরা নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলেও তুরাব পড়ে যান মিছিলের মধ্যে। যদিও তার পরনে প্রেস লেখা ভেস্ট ছিল। তারপরও পুলিশের ছোঁড়া সব গুলিই যেন তার গায়েই লাগলো। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই উপস্থিত সহকর্মীরা প্রথমে রিকশায় এবং পরে সিএনজিতে তুলে দিলে একজন পথচারি সেই দিন তুরাবকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত দৈনিক কালের কন্ঠের ফটো সাংবাদিক আশকার আমিন রাব্বি আমাকে ফোনে তুরাব গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান। সাথে সাথে আমি ঘটনাস্থলে এসে দেখি সাংবাদিকরা ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন। পুলিশ তখনও মারমুখি অবস্থানে। তবে কেউ আমাকে সঠিক সংবাদ দিতে পারছেন না গুলিবিদ্ধ তুরাবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক পর্যায় তুরাবের ফোনে কল দিলে কেউ একজন রিসিভ করে আমাকে জানায় গুলিবিদ্ধ তুরাবকে ওসমানী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর অন্য সহকর্মীরাও চলে আসেন। ততক্ষণে তুরাবের গুলিবিদ্ধ শরীরে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। উপস্থিত ফটো সাংবাদিক নুরুল ইসলাম, রেজা রুবেল, আজমল আলী, এমজেএইচ জামিল সহ আমরা তুরাবকে এক্সরে করার জন্য ২য় তলায় নিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর আসেন সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল কবির, নুর আহমদ ও লবিদ হোসেন। এক্সরে শেষে ফিল্মে গুলিবিদ্ধ পুরো শরীরের চিত্র দেখে সবাই থমকে যাই।
ওসমানী হাসপাতালে সঠিক কোনো চিকিৎসা হচ্ছিল না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়াতে তখন তুরাব প্রচুর ঘামছিল এবং বারবার পানিও চাচ্ছিল। একপর্যায় তুরাবের অবস্থার অবনতি দেখে আমি সহযোগিতার জন্য কল দেই সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজের ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহানগর জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলামকে। তিনি দ্রুত তুরাবকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।
অ্যাম্বুলেন্স করে তুরাবকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কিছুক্ষণের মধ্যে অবস্থার আরো অবনতি হয়। সাথে সাথে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তুরাবকে ইবনে সিনায় নিয়ে আসা থেকে পুরো বিষয়টি সহযোগিতা করেন মহানগর জামায়াতের আমীর ফখরুল ইসলাম। যদিও ভর্তির পর দ্রুত আইসিউতে চলে আসেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান মাওলানা হাবিবুর রহমান। শুক্রবার ছুটির দিন হলেও মাওলানা হাবিবুর রহমান বিশেষজ্ঞ কয়েকজন ডাক্তারকে কল দিয়ে নিয়ে আসেন। তুরাবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমি এবং তুরাবের ভাই জাবুরের সাথে তিনিও আইসিইউয়ের ভিতরে অবস্থান করেন। ভিতরে ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টা আর বাইরে পরিবার এবং সহকর্মীদের প্রার্থনা। কোনো কিছুতেই ফেরানো গেল না মাত্র ২ মাস পূর্বে বিয়ে করা তুরাবকে।
ফোনে তুরাব গুলিবিদ্ধের সংবাদ জানাই তার বড়ো ভাই জাবুরকে। একই সাথে আমাদের পত্রিকার সম্পাদনা সহকারী দাইয়ান চৌধুরীকে ফোনে তুরাবের বিষয়টি জানালে তিনি সিলেটস্থ বাসা থেকে তুরাবের মা এবং ভাবিকে নিয়ে আসেন ইবনে সিনায়। হাসপাতালে এসে মুমূর্ষু অবস্থায় তুরাবকে দেখে তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ইতিমধ্যে পরিবারের অন্য সদস্যরাও হাসপাতালে চলে আসেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মাগরিবের ঠিক আগ মুহূর্তে ৬টা ৪৪ মিনিটে তুরাব এই দুনিয়ার সফর শেষ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইতিমধ্যে প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে সবাই হাসপাতালে চলে আসেন।
ময়নাতদন্তের জন্য তুরাবকে নিয়ে আবার ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাই। গুলির সংখ্যা কম দেখানোসহ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরিতে নানান ষড়যন্ত্র করা হয়। ওসমানী হাসপাতালে তৎকালীন কতোয়ালী থানার ওসি মাঈন উদ্দিন শহীদ তুরাবের ভাই জাবুরের উপর চড়াও হন। উপস্থিত সাংবাদিকরা এগিয়ে এলে তিনি পিছু হটেন।
পরদিন প্রথম জানাজা মানিকপীর টিলা এবং শেষ জানাজার নামাজ তুরাবের গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌরসভার ফতেহপুরে অনুষ্ঠিত হয়। তুরাবের মরদেহ তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাবে কিছুক্ষণের জন্য নেওয়া হয়। দো’আ আর মানববন্ধন ছাড়া সরকারের চাপে বা রহস্যজনক কারণে সাংবাদিক সংগঠনগুলো তুরাব হত্যার বিচারের দাবিতে বড়ো কোনো কর্মসুচি দিতে পারেনি।
তার মৃত্যুর ৬-৭ দিন পর আমরা অজ্ঞাত পুলিশ সদস্যকে আসামি করে কোতওয়ালী থানায় অভিযোগ দাখিল করি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই অভিযোগ জিডি আকারে গ্রহণ করা হয়। অবশ্য ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর শহীদ তুরাবের ভাই জাবুর বাদি হয়ে ১৮ জনকে আসামি করে সিলেট মহানগর আদালতে অভিযোগ দাখিল করেন। এখন পর্যন্ত এসএমপির বরখাস্তকৃত এডিসি গোলাম দস্তগীর এবং কনস্টেবল উজ্জলকে আটক করা হয়। মামলাটি প্রথমে কতোয়ালী থানা পুলিশ এবং পরে পিবিআই তদন্ত করে। পরবর্তীতে এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এক বছরেও এই হত্যাকান্ডের বিচার দৃশ্যমান হয়নি। শহীদ তুরাবের দুখিনি মা বেঁচে আছেন কেবল এই নারকীয় হত্যাকান্ডের সুষ্টু বিচার দেখে যাওয়ার জন্য।
মৃত্যুযাত্রায় তুরাবের জীবন কর্মের সমাপ্তি হলেও সহকর্মীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামেনি আজও। সিলেট শহরের প্রতিটি মিছিলেই আমরা তুরাবকে খুঁজে বেড়াবো আজন্মকাল।