সীমাহীন লুটপাটে সাদাপাথর বিরাণভূমি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ৪:২৭:০১ অপরাহ্ন
* লুটপাটকারী কারা, দায় কার? * পদ স্থগিত বিএনপি
নেতার* জরুরী পর্যালোচনা সভা আজ*
এমজেএইচ জামিল ও আব্দুল জলিল :
লুটপাটে যেন এখন ‘এক বিরানভূমি’ সিলেটের ভোলাগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর। লুট হয়েছে শত শত কোটি টাকার পাথর এবং এখনো দিন-রাত লুট হচ্ছে সমানতালে। লুট করা এই পাথর নৌ ও সড়ক পথে যায় উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের সামনে দিয়ে। অন্যদিকে, সাদাপাথরের সাথেই রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প। প্রশ্ন উঠেছে, এরপরও পাথর লুট হয় কেমনে? আর দায় কার?
প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তুপের কারণে এ স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে গত কয়েক বছওে দেশজুড়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল। প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে তৈরি সাদাপাথওে সারাবছরই পর্যটনপ্রেমী মানুষের যেন মিলনমেলা হয়। সেই সাদাপাথরেই লাগলো অশুভ কালো হাত।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সাদাপাথর লুটপাটে বিলীন হয়েছে এর সৌন্দর্য্য। দিনে ও রাতে বাধাহীন লুটপাটে প্রায় হারতে বসেছে পর্যটন কেন্দ্রের সাদাপাথর। মাঝে মধ্যে পুলিশ বিজিবিকে সাথে নিয়ে লোকদেখানো অভিযান দেয় উপজেলা প্রশাসন। তাদের অভিযান শেষ হওয়ার আগেই আবারও শুরু হয় পাথর লুটপাট।
গত এক বছরে কী পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, সিলেটের পাথর কোয়ারি ও কোয়ারিভুক্ত এলাকা ছাড়া অন্যান্য স্থান থেকে অন্তত দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এভাবে লুটপাট অব্যাহত থাকলে সিলেট পাথরশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, পাথর খেকো এই চক্রটি সাদাপাথরের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়ে জিরো পয়েন্ট গিয়েও লুট করছে পাথর। এতে বাড়ছে জীবনের ঝুঁকি।
ওদিকে, সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে দলটি। রোববার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিএনপির আদর্শ ও নীতি পরিপন্থি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সকল পদ স্থগিত করা হয়েছে।
সরেজমিন সাদাপাথরে গিয়ে দেখা যায়, সাদাপাথরের মূল স্পটে পর্যটকরা সাঁতার কাটছেন আর তাদের পাশেই বারকি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে চলছে অবাধে পাথর লুট। ট্যুরিস্ট পুলিশের টিম সাদাপাথরে টহলে থাকার কথা থাকলেও তাদের দেখা যায়নি। যে যেরকম পারছে, সেরকম করে পাথর লুট করে নৌকায় তুলছে আর নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় কয়েক শতাধিক নৌকা করে নিয়ে যাচ্ছে এই পাথর।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকরা নৌকা দিয়ে সাদাপাথর লুট করছে। এই শ্রমিকদের প্রায় ৮০ ভাগ কোম্পানীগঞ্জের বাহিরের। তারা নৌকায় পাথর লুট করে ধলাই নদীর দয়ার বাজার, কালিবাড়ি, ভোলাগঞ্জ দশনম্বর ও গুচ্ছগ্রাম এলাকায় নিয়ে বিক্রি করে। ব্যবসায়ীরা নৌকা থেকে সেই পাথর কিনেন। নদী থেকে পাথর উত্তোলনে আইনী ঝুঁকি থাকলেও নৌকা থেকে পাথর কিনে বিক্রিতে কোনো আইনী ঝুঁকি নেই। যার কারণে পাথর কিনে মনমতো স্টক করে রাখা যায় এবং সারাদেশে পরিবহনের মাধ্যমে বিক্রিও করা যায়। এসব জায়গায় প্রশাসন কখনো অভিযান দেয় না।
সাদাপাথর ভোলাগঞ্জ থেকে সড়কপথে নিতে হলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে যেতে হয়। যেখানে উপজেলা পরিষদের গেইটের সামনে পুলিশ চেকপোস্ট থাকে। সেটার সামনে দিয়েই এই সাদাপাথর পরিবহন করা হয়। কোন অজানা কারণে এসব পাথর বহনকারী ট্রাক আটকায় না পুলিশ।
সাদাপাথরের কাছাকাছি ৩ টি বিজিবির ক্যাম্প রয়েছে। কালাসাদেক বিওপির অস্থায়ী ক্যাম্প (সাদাপাথর নৌকা ঘাট), কালাইরাগ ও পাথর কোয়ারি বিওপির সামন দিয়ে এসব লুটপাট হয়। পাথর লুটপাট করে জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করলেও বিজিবি তাতে বাঁধা দিচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানান, দিনরাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল আর টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করেন। হাজার হাজার বারকি নৌকায় সেসব পাথর বহন করে এনে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করেন তারা। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনরাত পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর থেকে পাথর লুটপাট হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিস্ক্রিয়। ভোলাগঞ্জ ও কালীবাড়ি গ্রামের পার্শবর্তী সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র। এই দুই গ্রামে রয়েছেন বিএনপি ও যুবদলের শীর্ষ স্থানীয় নেতা। তাদের ও ভোলাগঞ্জের অন্যান্যদের দখলকৃত জায়গা মাসিক ভাড়া নিয়ে চলছে সাদাপাথরের সাইট ব্যবসা। অন্যদিকে দয়ার বাজার, কালাইগর ও কালীবাড়ি এলাকার নদীর পাড়েও চলছে এমন সাইট ব্যবসা। যেখানে নৌকা থেকে পাথর ফেলে গাড়িতে বিক্রি করা হয়। কালীবাড়ি গ্রামে উপজেলার তিন জন বিএনপি নেতার বাড়ি। তাদের ভাই ও অনুগতরা পেলুডার দিয়ে পাথর পরিবহনের ট্রাক্টর গুলো নদী থেকে সড়কে তুলে দিতে সহযোগিতা করে। বিনিময়ে তারা ১ হাজার থেকে পনেরশো টাকা নিয়ে থাকেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যেখানে পরিবেশ উপদেষ্টা নিজেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন, সেখানে আমরা আর কি বলবো। সাদাপাথরে পাথর লুট সিলেটের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এর বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় সাদাপাথর পর্যটনের তালিকা থেকে হারিয়ে যাবে।
ওদিকে, সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সাদাপাথরে সরাসরি পুলিশের টহল দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের মাহমুদ আদনান। তিনি বলেন, এলাকাটি বিজিবি অধ্যুষিত এলাকা। যার কারণে সেখানে সরাসরি পুলিশের টহল দেওয়ার সুযোগ নেই। এরপরেও যতবারই টাস্কফোর্সের অভিযান হচ্ছে আমরা সেখানে তাদের সহযোগিতা করেছি। এমনকি আমরা এরই মধ্যে লুটের ঘটনায় প্রায় ১৭টি মামলা গ্রহণ করেছি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ৭০ জনকে। এছাড়া টাস্কফোর্সের অভিযানে প্রচুর জেল-জরিমানাও করা হয়েছে।
তবে বিজিবি বলছে তাদের দায়িত্ব সীমান্ত পাহারা ও চোরাচালান বন্ধ করা। পর্যটন স্পটে বিজিবি দাড়িয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত বিজিবি সদস্য তাদের নয়।
এ ব্যাপারে বিজিবি সিলেটের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল সাইফুল চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পাথর লুটের দায় বিজিবির না থাকার যথেস্ট কারণ রয়েছে। আবার কেউ দায় এড়াতেও পারিনা। সীমান্ত এলাকায় পুশ-ইন, পুশ-ব্যাক, মাদক ও পণ্য চোরাচালান রোধের কাজ শুধু বিজিবির। এই কাজে অন্য কোন বাহিনীর অংশগ্রহণ নেই। পাথর উত্তোলন বন্ধে টাস্কফোর্সের সকল অভিযানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিজিবি সদস্য অংশ নেন। কোন বাহিনীকে দোষারূপ না করে সাদাপাথর রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। এই উদ্যোগের সাথে স্থানীয় জনগণকেও সম্পৃক্ত রাখা উচিত। তাহলে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
এদিকে পাথর লুটের ঘটনায় জরুরী পর্যালোচনা আহ্বান করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোঃ মাহবুব মুরাদ। আজ বুধবার উক্ত সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে দৈনিক জালালাবাদকে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বেলাসহ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের রিটের প্রেক্ষিতে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে এসব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপর থেকে কাগজ কলমে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবের চিত্র ছিল উল্টো।
গেল বছরের ৫ আগস্টের পরে সিলেটের সাদাপাথরে লুটপাট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। টাস্কফোর্সের অভিযান ও পাথর খেকোদের লুকোচুরি যেন নিত্যদিনের চিত্র। পাথরকাণ্ডে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে বেশ কয়েকজন বিএনপি অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী বহিস্কৃত হন। মামলার আসামী এবং কারাগারেও গিয়েছেন বিএনপির কেউ কেউ। এরপরও থেমে থাকেনি পাথর লুটপাট। সর্বশেষ গত সোমবার পাথর লুটপাটে জড়িত থাকায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতির পদ স্থগিত করেছে বিএনপি।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, সাদাপাথর পর্যটন স্পট খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের মতো কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের টীম ইতোমধ্যে জায়গা পরিদর্শন করেছে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে আমরা পুলিশ, বিজিবির সমন্বয়ে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সাদাপাথর লুটপাটের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাদাপাথরের বিষয়টি নিয়ে বুধবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
তবে জেলা প্রশাসকের দাবি প্রশাসনের পদক্ষেপ চলমান রয়েছে এবং প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চলছে। তিনি বলেন, আইনি যত প্রক্রিয়া করা যায় আমরা সবগুলাই করেছি। এখানে মোবাইল কোর্টসহ টাস্কফোর্সের অভিযান এবং বিভিন্ন সময় নিয়মিত মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক কাসমির রেজা মনে করেন প্রশাসন কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না।
এ ব্যাপারে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সাদাপাথর এলাকায় পুলিশের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু ঐ জায়গায় ২৪ ঘন্টা বসিয়ে রাখার মতো জনবল আমাদের নেই। প্রশাসনের সাথে পুলিশ সবসময় দায়িত্ব পালন করছে। যখনই প্রশাসন অভিযান চালায় পুলিশ সহযোগিতা করছে। অভিযান শেষ হয়ে ফিরে আসা মাত্রই হাজার হাজার মানুষ যদি পাথর উত্তোলনে নামে তখন পুলিশের কি করার থাকে। পুলিশ টাস্কফোর্সকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।