ট্রাম্প-পুতিন ‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’ বৈঠক : চুক্তি না হলেও সুদৃঢ় সম্পর্কের বার্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ৯:১০:৪৪ অপরাহ্ন
ইউক্রেনের স্বস্তি, কিন্তু ভবিষ্যতের ভয়

জালালাবাদ রিপোর্ট : আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ শহরের অদূরে মার্কিন সেনাঘাঁটি ‘জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’-এ শুক্রবার গভীর রাতে (ভারতীয় সময়) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। কিন্তু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই দুই ক্ষমতাবান রাষ্ট্রনেতার মধ্যে বহুল আলোচিত আলাস্কা বৈঠক শেষ হয়েছে। বৈঠকের পর উভয় নেতাই আলাস্কা ছেড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের অ্যাঙ্কোরেজ শহরের একটি সামরিক ঘাঁটিতে শুক্রবার প্রায় তিন ঘণ্টা দীর্ঘ এ বৈঠক শেষে পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাদের বৈঠকে আলোচনায় অগ্রগতি হলেও এখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি তারা। তবে তিনি এটিও বলেছেন, পরবর্তীতে এ নিয়ে অগ্রগতি অর্জনের জন্য খুব ভালো সুযোগ রয়েছে।
যৌথ এই সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হোক তা তিনিও আন্তরিকভাবে চান। একই সাথে তিনি বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য এই যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলোও’ নিরসন করতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁর বার্তা, আমেরিকা ও রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করবে। সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতাই বক্তব্য দিলেও তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোন প্রশ্ন নেননি।
বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, খুব ভালো বৈঠক হয়েছে। বহুল আলোচিত এই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ট্রাম্প জানিয়েছেন যে আলোচনা শেষে তিনি জেলেনস্কি এবং ইউরোপীয় নেতাদের সাথে ফোনে কথা বলবেন।
এদিকে এই বৈঠকের এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ক্রেমলিন। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ট্রাম্প ও পুতিন বৈঠকটি ছিল খুবই ইতিবাচক।উত্তর আমেরিকা থেকে বিবিসি সংবাদদাতারা ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের সংবাদ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। এই বৈঠকের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার জন্য কী অর্থ বহন করে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ কী হতে পারে সেটিও বিশ্লেষণ করেছেন তারা।
‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’ :
‘এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’-এর অধিবেশনকক্ষে নয়, ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনা রানওয়েতে দাঁড়ানো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্যাডিলাক লিম্যুজিনে (সরকারি পরিভাষায় যার নাম ‘দ্য বিস্ট) সওয়ার হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল বলে মস্কোর দাবি। গাড়িতে পাশাপাশি বসেছিলেন তাঁরা দু’জন। সেখানে একান্ত আলাপচারিতাতেই শীর্ষ বৈঠকের রূপরেখার প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছিল। ‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’ অনুসরণ করে মূল আলোচনার পথ মসৃণ হয়েছে বলেই ‘তাস’-কে জানিয়েছে ক্রেমলিন প্রেস সার্ভিস।
মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠকে দুই রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে আরও দু’জন করে শীর্ষ সরকারি আধিকারিক হাজির ছিলেন। কূটনীতির পরিভাষায় একেই ‘থ্রি-অন-থ্রি ফরম্যাট’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিয়ো এবং প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। অন্যদিকে, পুতিনের সফরসঙ্গী রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ক্রেমলিনে প্রেসিডেন্টের সহকারী ইউরি উশাকভ। বৈঠকশেষে দুই রাষ্ট্রনেতা যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে যে ঘোষণা করেন, তার রূপরেখা তৈরির বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল চার সহযোগীর।
আলাস্কা বৈঠক ট্রাম্পের খ্যাতি নষ্ট করলো :
বিবিসির উত্তর আমেরিকান সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরচার তার বিশ্লেষণে বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ‘চুক্তির কারিগর’ হিসেবে উপস্থাপন করার যে চেষ্টা করে আসছিলেন, আলাস্কা বৈঠক তার সেই অবস্থান নষ্ট করেছে। কেননা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বৈঠকের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে কোনো চুক্তি হয়েছে।
জুরচারের মতে, ট্রাম্পের এই বক্তব্যের মানে দাঁড়ায় আসলে এই বৈঠক থেকে কিছুই অর্জিত হয়নি, সংবাদ সম্মেলনে যেটিকে একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তর দিয়েছেন ট্রাম্প।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শত শত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তাদের কোনো প্রশ্ন না নিয়েই সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন উভয় নেতা।এতদূর থেকে এসে দীর্ঘ বৈঠকের পর ট্রাম্প গণমাধ্যমের উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটিও ছিল একেবারে অস্পষ্ট।
অন্যদিকে, বলা হচ্ছে এ নিয়ে পরবর্তী বৈঠক মস্কোতে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেই বৈঠকে জেলনস্কি থাকবেন কি-না, কিংবা কী চুক্তি হতে পারে সেখানে সেটি নিয়েও কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই।
যদিও আলাস্কার এই আলোচনায় ট্রাম্পের চেয়ে রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনের ঝুঁকি কম ছিল। তবুও এটি তার খ্যাতিতে আঘাত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা এই বৈঠকের আগেই ট্রাম্প বলেছিলেন এই বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২৫ শতাংশ।
তাছাড়া, পুতিন যখন সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও ছিলেন চুপচাপ। এটি ওভাল অফিসের সাধারণ রুটিনের চেয়ে একেবারে আলাদা। কেননা, সেখানে সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টই শুরুতেই বক্তব্য দিয়ে থাকেন।
যদিও মার্কিন মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেখানে তিনি এই বৈঠককে মূল্যায়ন করেছেন ‘১০-এ ১০’ নম্বর দিয়ে। তিনি এটিও বলেছেন যে আমাদের মধ্যে আলোচনা খুব ইতিবাচক হয়েছে।
ইউক্রেনের স্বস্তি, কিন্তু ভবিষ্যতের ভয় :
আঙ্কোরেজের এই বৈঠকে যে ধরনের ফলাফলের কথা ধারণা করা হচ্ছিল তা হয়নি। ফলে এই বিষয়টি সাময়িকভাবে কিয়েভকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে বলে মনে করেন বিবিসি মনিটরিংয়ের রাশিয়ান সম্পাদক ভিটালি শেভচেঙ্কো।
ইউক্রেনের মানুষ জানবে যে, রাশিয়ার সাথে তাদের যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ভেস্তে গেছে সেটি যদি আঙ্কোরেজের বৈঠকে ঘোষণা করা হতো সেটি সন্দেহের চোখেই দেখা হতো। যদিও তেমনটি হয়নি।
তবে ইউক্রেনের মানুষ আতঙ্কিত, কারণ পুতিন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে “সংঘাতের মূল কারণ” উল্লেখ করেছেন এবং এই সংকট সমাধান করেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।ক্রেমলিনের ভাষায় এর অর্থ দাঁড়ায়-ইউক্রেনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ধ্বংস করার ব্যাপারে এখনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাশিয়া।যে কারণে তিন বছর ধরেও এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়নি। এমনকি আলাস্কার বৈঠকও পুতিনের মন পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে। বৈঠকের পর যে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে তা উদ্বেগজনক। আগামীতে কী হবে? রাশিয়ার হামলা অব্যাহত রাখবে কী?
গত কয়েক মাসে পশ্চিমা দেশগুলো নির্ধারিত সময়সীমা দিয়ে হুমকি দিলেও কোনো ফল হয়নি। ইউক্রেনের জনগণ মনে করছেন ভবিষ্যতেও চলবে এই হামলা। যে কারণে মনে করা হচ্ছে যে আলাস্কায় আসলে কোনো অর্জনই হয়নি।







