হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মোড়
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:২৩:০৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন বেশ পুরনো। বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের সময় বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে লাগে। তবে হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। কুটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বৈঠকে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মূলত হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে কূটনৈতিক সুযোগ দেখছে ইসলামাবাদ। যার ফলে বাংলাদেশে ২০২৬ সালের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগেই পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এরকম তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৩ আগস্ট দুই দিনে সফরে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এর মাধ্যমে ১৩ বছর পর কোনো শীর্ষ পাকিস্তানি কর্মকর্তা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন।
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা ইসহাক দার এ সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি হবে দুই দেশের ‘অংশীদারিত্বের নতুন অধ্যায়’। তিনি স্বীকার করেন, গত এক বছরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অগ্রগতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে, যেখানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম, কোয়েটা থেকে রাজশাহী, পেশোয়ার থেকে সিলেট এবং লাহোর থেকে ঢাকা— দুই দেশের তরুণরা হাতে হাত মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে, ভাগাভাগি করবে তাদের স্বপ্ন।’
ইসহাক দারের এ সফর মূলত কয়েক মাস ধরে চলা কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগের পর বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষত, ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে ভারতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
এদিকে চীনে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ খালিদ সতর্ক করে বলেন, অতীত এখনো দুই দেশের আস্থা তৈরিতে বাধা হয়ে আছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সম্পর্কের পথে কৃত্রিম বাধাগুলো এখন দূর হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক গভীর করতে হলে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার একটি কাঠামো প্রয়োজন।’
সামরিক ও কূটনৈতিক যোগাযোগ বেড়েছে: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মাত্র দুইবার বৈঠক করেছেন। এর মধ্যেই এত দ্রুত সম্পর্ক উষ্ণ হয়ে উঠবে, তা ধারণা করেননি বিশ্লেষকরা।
এদিকে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান ইসলামাবাদে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে যান বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান। এরপর এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বেলুচ ঢাকায় আসেন।
এরপর মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের সংঘাতের কারণে ইসহাক দারের সফর পিছিয়ে যায়। তবে জুলাইয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি ঢাকা সফর করেন। অবশেষে আগস্টে দার ঢাকায় এলেন, একই সময়ে পাকিস্তানে যান বাংলাদেশের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান। সেখানে তিনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন মনে করেন, পাকিস্তানের এই ‘তাড়াহুড়ো প্রচেষ্টা’ কৌশলগত। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, ‘হাসিনা সরকারের আমলেও পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়েছে। এখন তারা ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের মতো সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেখছে।’
তিনি মনে করিয়ে দেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল।’
অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে শাসন পরিবর্তন প্রায়ই ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করেছে। পাকিস্তান হয়তো বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনকেও কাজে লাগাতে চাইছে। এটি একটি সাধারণ কূটনৈতিক অনুশীলন।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার: কয়েক দশক ধরে ইসলামাবাদ এবং নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টি দিয়ে দেখে আসছে, যার মূলে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। সেই ইতিহাস এখনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে গভীর ছায়া ফেলছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী বাহিনীর হাতে লাখো বাঙালি নিহত হয়, প্রায় দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী মনে করেন, ভারতের “আঞ্চলিক আধিপত্য” নিয়ে অভিন্ন অভিযোগ ইসলামাবাদ এবং ঢাকাকে সম্পর্ক মেরামত করতে উৎসাহিত করেছে। গত মে মাসে কাশ্মিরে হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের আকাশযুদ্ধে এই বিরোধ আবার প্রকট হয়ে ওঠে। উভয় দেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে,।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শাহাব এনাম খান মনে করেন, ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক এখন কিছুটা শীতল হলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত অর্থনীতিনির্ভর। ভারত-বিরোধী মনোভাব প্রায়ই অতিরঞ্জিত করা হয়। তবে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্ক, বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে, কেবল নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এড়িয়ে চলে, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়।’
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব: চীন বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ভাবে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও বেইজিংয়ের সঙ্গেও শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভালো ছিল।
অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন বলেন, অন্তর্র্বতীকালীন সরকার আসার পরও চীন তার অবস্থান ধরে রেখেছে। মার্চে ড. ইউনূস বেইজিং সফর করেন। আগস্টে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক সপ্তাহের সফরে চীনে যান।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ১২টি চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয় বিবেচনা করছে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সংঘাতে পাকিস্তান এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বও গভীর। এসব কারণে ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে।
বাণিজ্য ও রাজনীতির মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা: ইসহাক দার দুই দিনের সফরে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ ভূমিকা রাখা ছাত্রনেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) ছিল।
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক আবদুল বাসিত বলেন, বাংলাদেশে ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হবে, তার আগে এসব বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। অতীতের সমস্যাগুলো দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে হবে।’
অর্থনীতিতেও উভয় দেশ উপকৃত হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে, পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি মাত্র ২.৫ শতাংশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও এখনো সীমিত। ২০২৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৬৬১ মিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করেছে, বিপরীতে আমদানি মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিলওয়ার হোসেন বলেন, পাকিস্তান থেকে তুলা, টেক্সটাইল, চাল, সিমেন্ট, ফল ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, পাকিস্তান আমদানি করতে পারে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য, কেমিক্যাল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও তামাকজাত দ্রব্য। তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ৪৩০ মিলিয়ন—যা পশ্চিম ইউরোপের দ্বিগুণেরও বেশি।