মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন দম্পতির হাতে দুর্নীতির সাম্রাজ্য: ১.৪ মিলিয়ন রিঙ্গিত সোনা জব্দ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৭:৫১:০৯ অপরাহ্ন
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) এক অভাবনীয় অভিযানে ইমিগ্রেশন বিভাগের এক বিবাহিত দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযোগ, তারা ঘুষকে পার্শ্ব আয়ের লাভজনক উৎসে পরিণত করে অবৈধ উপার্জনে সোনার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল।
দুর্নীতি দমন কমিশন-এর তথ্যমতে, ৪০ বছর বয়সী এ দম্পতি একটি পাল্টা-সেটিং সিন্ডিকেটের মূল খেলোয়াড়, যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিদেশিদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশ ও কাজ করার সুযোগ করে দিত। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, তারা ২০২০ সাল থেকে ঘুষের টাকা ব্যবহার করে স্ত্রীর ভাইবোন ও সন্তানদের নাম প্রোক্সি হিসেবে ব্যবহার করে একটি গয়নার দোকান চালু করে, যার প্রাথমিক মূলধন ছিল ৬ লাখ রিঙ্গিত।
ডেপুটি চিফ কমিশনার (অপারেশনস) আহমেদ খুসাইরি ইয়াহায়া জানান, সিন্ডিকেটের আওতায় বিদেশি শ্রমিকদের ফাইল প্রক্রিয়াজাত করার সময় নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায় করা হতো। সাত দিনের কাজ তিন দিনে শেষ করে দেওয়ার বিনিময়ে প্রতিটি বিদেশি কর্মীর জন্য ৭০০ রিঙ্গিত ঘুষ নিত দম্পতি। এর মধ্যে ১৫০ রিঙ্গিত সরাসরি তাদের পকেটে যেত, আর বাকিটা ভাগ হতো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে।
চার বছরে শুধু ঘুষ থেকেই এ দম্পতি প্রায় ৯ লাখ রিঙ্গিত হাতিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ অর্থ দিয়ে তারা একটি সোনার দোকান খোলার পাশাপাশি বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছে।
সম্প্রতি পাহাংয়ে গয়নার দোকানে অভিযানে প্রায় তিন কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১.৪ মিলিয়ন রিঙ্গিত। “অপস ডাইগো” নামের বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দম্পতিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৯-এর ধারা ১৬(এ)(বি) এর অধীনে তদন্তাধীন।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। এর আগেও বারবার বিদেশি কর্মী পাচার, জাল ভিসা তৈরি, অবৈধ লেনদেন এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশের ঘটনা সামনে এসেছে।
২০২২ সালে “অপস জাগা” অভিযানে কয়েক ডজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, যারা বিদেশিদের প্রবেশ সহজ করতে ঘুষ নিতেন। ২০২৩ সালে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (কেএলআইএ) একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদেশিদের অবৈধ প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, ইমিগ্রেশন দুর্নীতি একটি দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
এই ধরনের কেলেঙ্কারি শুধু দেশের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিদেশি শ্রমবাজার, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী এবং পর্যটকরা দেশটির প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেন। বিশেষত, মানব পাচার ও অবৈধ শ্রম বাণিজ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলোতেও নেতিবাচকভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আশপাশের অঞ্চলে ইমিগ্রেশন দুর্নীতি একটি সাধারণ সমস্যা। থাইল্যান্ডে, সীমান্তবর্তী এলাকায় বহুবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত, অভিবাসী শ্রমিক ও শরণার্থীদের প্রবেশে ঘুষ একটি “প্রাতিষ্ঠানিক প্রথা” হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, থাই কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কারণে মানব পাচারকারীরা সহজেই সিন্ডিকেট চালাতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ায়, বিদেশি শ্রমিকদের ভিসা ও পারমিট প্রদানে দুর্নীতির অভিযোগ বহু বছর ধরে চলছে। জাকার্তা ও অন্যান্য বড় শহরের ইমিগ্রেশন অফিসে ভিসা নবায়ন দ্রুত করতে ঘুষ আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে, বিদেশগামী শ্রমিকদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রক্রিয়ায় ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগ পুরনো। মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে শ্রম পাঠানোর ক্ষেত্রে জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে কর্মকর্তারা অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন। এর ফলে সাধারণ শ্রমিকরা হয়রানির শিকার হন এবং বৈধ উপায়ে বিদেশগমনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়।
এই তুলনামূলক চিত্র প্রমাণ করে যে দুর্নীতি একটি আঞ্চলিক সংকট। তবে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট, কারণ দেশটি বিদেশি শ্রমিক ও পর্যটকের অন্যতম বড় গন্তব্য। এখানকার ইমিগ্রেশন দুর্নীতি আন্তর্জাতিক নজরে পড়লে তা সরাসরি দেশের অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও বৈশ্বিক ভাবমূর্তির ওপর আঘাত হানে।
দুর্নীতি বিষয়ক আইনজীবী দাতুক শামসুদ্দিন আব্দুল্লাহ মনে করেন, “সরকারি কর্মকর্তারা যদি সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েন, তবে তা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, জাতীয় নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে। এই ঘটনা প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতা ও জবাবদিহিতার অভাবকেই প্রকাশ করছে।”
অন্যদিকে দুর্নীতি বিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ার সাবেক সভাপতি আকবর সাইফুল বলেছেন, ঘুষের এই চক্র কেবল ইমিগ্রেশনে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতার প্রতিফলন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে এই দুর্নীতির সংস্কৃতি আরও গভীর শিকড় গেড়ে বসবে।