পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি : বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০১:১০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত বুধবার যখন সৌদি আরবের আকাশসীমায় প্রবেশ করেন তখন এফ-১৫ যুদ্ধবিমান তাঁকে এসকর্ট দিয়ে এগিয়ে নেয়। রাজকীয় মর্যাদায় দেওয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা। এরপর তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকে বসে। সেই বৈঠকে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি-এসএমডিএ’ স্বাক্ষরিত হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি দুই দেশের ৮ দশক পুরোনো সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদে এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা।
এই চুক্তি এমন এক সময় স্বাক্ষরিত হলো-যখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। গাজায় দুই বছর ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন, প্রায়শই প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইসরায়েলের হামলা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস আগেই পাকিস্তান ও ভারত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। চলতি বছরের মে মাসে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সংঘাতে উভয় দেশ একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। চার দিনের এই সংঘর্ষ দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধর দুই প্রতিবেশীকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তিটি ‘নিরাপত্তা জোরদার এবং আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখার’ ক্ষেত্রে উভয় দেশের ‘সাধারণ অঙ্গীকার’ প্রতিফলিত করে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ‘যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলা। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘চুক্তি অনুযায়ী, কোনো দেশ যদি এই চুক্তিভুক্ত দুই দেশের কোনো একটির বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালায়, তা উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আসফান্দিয়ার মীর এই চুক্তিকে উভয় দেশের জন্য ‘মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, পাকিস্তান স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, কিন্তু ৭০-এর দশকে তা ভেঙে যায়। চীনের সঙ্গে বিস্তৃত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নেই।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, সিডনির দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা গবেষক মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, চুক্তিটি পাকিস্তানের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপসাগরীয় অংশীদারদের সঙ্গে অনুরূপ দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি রূপরেখা হিসেবে কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, ক্ষেত্র বিশেষে, এই চুক্তি এরই মধ্যে চলমান বহুমুখী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংহত ও আনুষ্ঠানিক করবে। পাশাপাশি যৌথ প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা উৎপাদন এবং সৌদি আরবে পাকিস্তানি সেনা টহল সম্প্রসারণের নতুন সুযোগ অনুসন্ধান করা হবে।
সৌদি-পাকিস্তান ঐতিহাসিক বন্ধন ও সামরিক সহযোগিতা :
পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের আগস্টে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম যেসব দেশ স্বীকৃতি দেয়, সেগুলোর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। ১৯৫১ সালে দুই দেশ ‘মৈত্রী চুক্তি’ করে। এই চুক্তিই মূলত দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো কৌশলগত, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করে।
বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরবে মোতায়েন করা হয়েছে এবং সৌদি সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৬৭ সাল থেকে পাকিস্তান ৮ হাজারের বেশি সৌদি সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি এই সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করেছে। এই চুক্তির আওতায় সৌদি আরবে ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মী প্রেরণ ও সামরিক প্রশিক্ষণ’ নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক চুক্তি সময় এল যখন মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও বিনা উসকানিতে প্রতিবেশীদের ভূমিতে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর উপসাগরীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন, যদিও তারা এখনো মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
কাতারে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) সদর দপ্তর থাকলেও দেশটিতে ইসরায়েল গত ৯ সেপ্টেম্বর হামলা চালিয়েছে। এর বাইরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০–৫০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন আছে বিভিন্ন ছোট–বড় ঘাঁটিতে। এমনকি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের বাইরে প্রিন্স সুলতান বিমানঘাঁটিও রয়েছে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে। সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক এই চুক্তি অন্তত এক বছর ধরেই প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হচ্ছিল না। তবে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, এই চুক্তির ভাষা মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘চাঞ্চল্যকর’ বলেই মনে হবে।
সাহার খান বলেন, ওয়াশিংটনে পাকিস্তানকে নিয়ে আস্থার সংকট আছে এবং এই চুক্তি তা কমাবে না।
খাদের কিনারায় ঝুলে থাকা এক অশান্ত অঞ্চল :
চলতি বছর ইসরায়েল ও ইরান ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ বেসামরিক ও সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শেষ পর্যায়ে এসে মার্কিন যুদ্ধবিমানও অংশ নেয়। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ভয়ংকর বাংকার-বাস্টার বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র।
এর তিন মাস পর ইসরায়েল দোহায় কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত সবুজ-শ্যামল একটি এলাকায় হামলা চালায়। সেখানে দূতাবাস, সুপারমার্কেট ও স্কুল আছে। ওই হামলায় অন্তত পাঁচজন কথিত হামাস সদস্য ও কাতারের এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। এই হামলার পর আরব ও ইসলামি দেশগুলো জরুরী বৈঠকে বসে। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) ছয় দেশ—বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার ঘোষণা দেয়। মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, পাকিস্তান-সৌদি আরব চুক্তিকে এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।
ভারত প্রশ্ন :
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এই প্রতিরক্ষা চুক্তি আলোড়ন তুলবে ভারতেও। পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক জন্মলগ্ন থেকেই তলানিতে। গত এপ্রিলে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর আরও খারাপ হয়েছে। এর পরপরই দুই দেশ চার দিনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১০ মে যুদ্ধবিরতি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, এটি তাঁর মধ্যস্থতায় সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তান সেটি স্বীকার করলেনও ভারত বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
সৌদি আরব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ভারত সরকার ওই চুক্তির ব্যাপারে অবগত। তিনি বলেন, আমরা এই ঘটনার প্রভাব আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর কী হতে পারে, তা পর্যালোচনা করব।
সিডনিভিত্তিক বিশ্লেষক ফয়সাল এ বিষয়ে বলেন, এই চুক্তি পাকিস্তান-সৌদি আরব সম্পর্কে নতুন ভারসাম্য এনে দিতে পারে। এত দিন এই সম্পর্কে মূলত প্রাধান্য ছিল পাকিস্তানের বিপর্যস্ত অর্থনীতির জন্য সৌদির আর্থিক সহায়তা। এদিকে, রিয়াদ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে তুলছিল। ফয়সাল বলেন, পাকিস্তানের অবস্থান কিছুটা উন্নত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে পাকিস্তান-সৌদি আরব সহযোগিতা বাড়ানোর নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে।
মীর এ বিষয়ে বলেন, নতুন এই চুক্তি দেখিয়ে দিল, সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে এখনো মূল্যায়ন করছে। ভারতের চেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিবেশী অঞ্চলে একঘরে হয়ে পড়েনি।
পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তির ছায়াতলে সৌদি আরব :
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক কাজে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করছে। লক্ষ্য হলো জ্বালানি খাতে বৈচিত্র্য আনা, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো। গত জানুয়ারিতে সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান আল সৌদ আবারও জানান, রিয়াদ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও বিক্রির জন্য প্রস্তুত।
তবে সৌদি আরব বারবার স্পষ্ট করে বলেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর পথে হাঁটতে চায় না। ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইয়ে মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড উল্লেখ করেন, এক আলোচনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নাকি মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকে বলেছিলেন-রিয়াদ কেবল জ্বালানি উৎপাদনের জন্যই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে। গ্রাহাম এ নিয়ে উদ্বেগ জানালে যুবরাজের জবাব ছিল, বোমা বানাতে আমার ইউরেনিয়ামের দরকার নেই। আমি চাইলে পাকিস্তান থেকেই একটি কিনে নিতে পারি।