কার্গো ভিলেজে আগুন নির্বাপণ ছিল না নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাপনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০০:৫৪ অপরাহ্ন
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১শ কোটি টাকার বেশি: বিজিএমইএ | ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক, কোর কমিটি গঠন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আগুন দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়েছে। কার্গো ভিলেজে আগুন নির্বাপণে নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। কার্গো ভিলেজে স্টিলের অবকাঠামোর পাশাপাশি ছোটো ছোটো কম্পার্টমেন্ট থাকায় আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। রোববার বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এ তথ্য জানান।
ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শনিবার রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও রোববার বিকেলে সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কার্গো ভিলেজের আগুন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটের দিকে সম্পূর্ণ নির্বাপণ হয়েছে। ভেতরে যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকলে আগুন নেভাতে এত বেগ পেতে হতো না। স্টিলের পরিমাণ বেশি থাকায় তাপ বেশি ধারণ করেছে।’তিনি বলেন, ‘আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ হলেও ফায়ারের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে অবস্থান করবে। ওখানকার স্টোরটি খুবই সংকীর্ণ ছিল। অনেক দাহ্য জিনিস ছিল, এজন্যই দেরি হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসকে ঢুকতে না দেয়ার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।’
ফায়ার সার্ভিসের এ পরিচালক জানান, কার্গো ভিলেজের যেখান থেকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেখানে যদি অগ্নি সতর্কতার (ফায়ার ডিটেকটেড সিস্টেম) থাকতো, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। যে কারণে আগুন নেভাতেও বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।
ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কার্গো ভিলেজের কলামের ভিতরে ফাটল ধরেছে, ভবনগুলো অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ। কেমিক্যালের কারণে কিছুটা পরিবেশের ঝুঁকি থাকে, তবে অতটাও নয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ারের ২ জন আহত হয়েছেন।’
এরআগে শনিবার দুপুরে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট আগুনে নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আগুন লাগার পর মুহূর্তেই কালো ধোঁয়া উড়তে থাকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই ধোঁয়া দেখা যায় প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার দূর থেকেও।
ঘটনার পর শনিবার রাত ৯টা থেকে ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এই ঘটনায় ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে তাদের চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুইজন, আনসারের ২৫ জন এবং অন্যান্য সংস্থার ১০ জন মিলে মোট ৩৭ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে রোববার সকালে বাণিজ্য উপদেষ্টা, বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা ও বিজিএমই’র সভাপতি বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন। এসময় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছে বিজিএমইএ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে প্রধান করে অগ্নিকাÐ তদন্তসহ আগুন লাগা প্রতিরোধে ১২ সদস্যের কোর কমিটি গঠন করেছে সরকার।
বিমানবন্দরে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি: বিজিএমইএ: রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ (পণ্য রাখার স্থান) কমপ্লেক্সে অগ্নিকাÐের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে অনুমান তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের।রোববার দুপুরে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইনামুল হক খানের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিজিএমইএর সহসভাপতি মিজানুর রহমান, পরিচালক ফয়সাল সামাদ প্রমুখ। পরে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সামনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইনামুল হক। তিনি বলেন, সাধারণত উচ্চমূল্যের পণ্য এবং জরুরি শিপমেন্টের ক্ষেত্রে আকাশপথে জাহাজীকরণ করা হয়। অগ্নিকাÐের ফলে তৈরি পোশাক, মূল্যবান কাঁচামাল এবং নতুন ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ইনামুল হক খান বলেন, এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আগুনে যে পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়েছে, তা শুধু বর্তমান রপ্তানির ক্ষতি নয়, ভবিষ্যতের ব্যবসায়িক সুযোগও ব্যাহত করবে। বিজিএমইএ ইতিমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ শুরু করেছে। সদস্যদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফরমে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের তালিকা চাওয়া হয়েছে। দ্রæত তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি অনলাইন পোর্টাল খোলা হয়েছে।’
প্রতিদিন ২০০-২৫০টি কারখানার পণ্য আকাশপথে রপ্তানি হয় জানিয়ে ইনামুল হক খান বলেন, ক্ষতির পরিমাণ বিপুল হতে পারে। সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে শিগগিরই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে একটি সমন্বয় সভা করবে বিজিএমইএ।
এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি। পুরো ইমপোর্ট সেকশন পুড়ে গেছে। আমাদের অনুমান, ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) টাকার বেশি হতে পারে।’ তিনি জানান, ঘটনাস্থলে বাণিজ্য উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন পণ্যের আমদানি কার্যক্রমে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আপাতত টার্মিনাল-৩-এ নতুন স্থানে আমদানি পণ্য রাখার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা। এ ছাড়া ৭২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে দ্রæত পণ্য খালাস করার নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা।
ফয়সাল সামাদ আরও বলেন, কাস্টমসের সঙ্গে যৌথভাবে একটি ওয়ার্কিং কমিটি করা হচ্ছে, যাতে দ্রæত মালামাল খালাস করা যায়। এমনকি শুক্র-শনিবারও কাজ চলবে। ব্যবসার স্বার্থে এখন আর সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে না।
মওকুফ হবে দুই দিনের মাশুল: অপরদিকে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাÐের ঘটনায় দুই দিন ধরে চলা ফ্লাইট বিপর্যয়ের মাশুল সরকার মওকুফ করবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। রোববার বিমানবন্দরের কার্গো গেটের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এ তথ্য জানান।
উপদেষ্টা বলেন, “অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। ফায়ার সার্ভিস সময়মতো ও সঠিকভাবে কাজ করতে পেরেছে। যত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সবগুলোই তদন্তের আওতায় আনা হবে। শুরুতে মালামাল সরানোর সুযোগ না থাকায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন, “দুই দিন ধরে যে ফ্লাইট বিপর্যয় হয়েছে, তার মাশুল সরকার মওকুফ করে দেবে।”
স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে কোর কমিটি: কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাÐ তদন্তসহ আগুন লাগা প্রতিরোধে কোর কমিটি গঠন করেছে সরকার। ১২ সদস্যের এ কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। রোববার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির জরুরি সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) সাংবাদিকদের এ কথা জানান। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাÐের পরিপ্রেক্ষিতে এ সভা করা হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনসহ কমিটির সদস্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।ফারুক ই আজম বলেন, আগুন লাগার পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে আমরা সভায় সেটা নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলেছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী নির্দেশিকা অনুসারে আজ এই সভা হয়েছে।
তিনি বলেন, একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। এটি ১২ সদস্য বিশিষ্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিনিয়র সচিব কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন। এ কমিটির সভা আবার আগামী ৫ নভেম্বর হবে, তাই আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে এ কমিটি রিপোর্ট দাখিল করবে। এই কমিটির সুপারিশ অনুসারে পরিকল্পনা নেওয়া হবে।








