প্রশাসনে পদোন্নতির ফাইলে নড়চড় কর্মকর্তা সচিব হচ্ছেন এক ডজন
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ৮:২৪:০৬ অপরাহ্ন

জালালাবাদ ডেস্ক: নির্বাচনের আগে প্রশাসনের অদক্ষতা কাটানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে অনেক দিন ধরে সচিব পদ শূন্য। অতিরিক্ত বা রুটিন দায়িত্ব দিয়ে চালাতে হচ্ছে কার্যক্রম। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আটকে আছে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তত হাফ ডজন ব্যক্তিকে একসঙ্গে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সম্প্রতি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড-এসএসবির বৈঠক হয়েছে। তবে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। অভিযোগ আছে, বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরাই তদবিরে এগিয়ে আছেন।
অন্যদিকে নিয়োগপ্রাপ্ত চুক্তিভিত্তিক সচিবদের পারফরমেন্স পুনর্ম‚ল্যায়নের চিন্তা চলছে। একই সঙ্গে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচ থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ফাইলও নতুন করে পর্যালোচনা করতে চাইছে সরকার। এতে শতাধিক ব্যক্তি পদোন্নতির মুখ দেখবেন। মাঠ প্রশাসনেও নতুন মুখ আসছে নির্বাাচন ঘিরে। খুব দ্রæত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, সচিব পদে পদোন্নতির আশায় থাকা প্রশাসন ক্যডারের ১৫ ও ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে। ১৫ ব্যাচ থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই সচিব হয়েছেন। নতুন করে ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের থেকে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তা উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি দক্ষ কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এ দক্ষতার মানদÐ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে একটি অংশের। তারা মনে করেন, বিগত সরকারের আমলে যারা বঞ্চিত ছিলেন তাদের অনেকে ছিলেন কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আবার অনেককেই পটপরিবর্তনের পর ভ‚তাপেক্ষ পদোন্নতি দেয় বর্তমান সরকার। ফলে বঞ্চিতদের কেউ কেউ
তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হননি। সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেলে নিজের মেধার সেরাটা দিতে পারবেন, এমন দাবি করে তাদের দৌড়ঝাঁপ চলছে। নিয়মিত পদোন্নতিপ্রাপ্তদের কেউ কেউ আবার হাসিনা সরকারের অন্যায় সুবিধাভোগী। পটপরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক খোলস পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন। এটাও ঠিক, দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে অভিজ্ঞতার কিঞ্চিৎ ঘাটতি রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাবেন বলে মনে করছে প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে পদায়ন ও বদলির বিষয় উঠে এসেছে। মাঠ প্রশাসনে যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের পদায়নের কথা বলা হয়। আলোচনায় আসন্ন নির্বাচনে প্রশাসনের দক্ষতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ বৈঠকেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং।
বৈঠকে বলা হয়, মাঠ প্রশাসনে পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গণমাধ্যমে অনিয়মের প্রতিবেদন হয়েছে কিনা, তা দেখা হবে। সবচেয়ে ফিট কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। তবে নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন কিনা, পদায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়েও লক্ষ রাখা হবে। আগামী ১ নভেম্বর এই কার্যক্রম শুরু হবে।
তথ্যমতে, বর্তমানে বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব রয়েছেন। এর মধ্যে বিসিএস-৮২ ব্যাচের কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সচিবদের মধ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্ত হিসেবে চুক্তিভিত্তিক এ কর্মকর্তা সেখানে কী দায়িত্ব পালন করছেন তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। নৌ মন্ত্রণালয়ে এখনও সচিব পদে কাউকে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া গত ২৭ মার্চ থেকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে সচিব নেই। একইভাবে গত ২৭ আগস্টের পর থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব পদ ফাঁকা। গত ২১ অক্টোবর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমানকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৬ অক্টোবর থেকে ফাঁকা রয়েছে বস্ত্র ও পাট সচিবের পদ। ১২ অক্টোবর থেকে খালি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের পদ। নিয়মিত সচিব না থাকায় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের প্রশাসন চালাতে গিয়ে বারবার সিদ্ধান্তহীনতা দেখা গেছে। গত এক বছর প্রশাসনে বদলি-পদোন্নতির আদেশ দ্রæত পরিবর্তনে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রয়েছে। আবার চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তাদের সচিব বানিয়ে প্রশাসন পরিচালনায় ভরসা করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর একটা প্রেক্ষাপটও আছে। বিগত হাসিনার সরকারের আমলে বঞ্চিত হন কিছু কর্মকর্তা। তাদের কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল বিএনপি সরকারের তৎকালীন মন্ত্রীদের পিএস বা ওই সরকারপন্থি হওয়ার কারণে। আওয়ামী আমলের পতনের পর একটি ব্যাচের বেশির ভাগ কর্মকর্তা সচিবের দায়িত্ব পান। তবে প্রথম দিকে এ নিয়ে আপত্তি না এলেও সম্প্রতি নিয়মিত কর্মকর্তারা ভিন্ন বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। তাদের মতে, সরকার কর্মচারীদের অবসরে পাঠানোর মানে হচ্ছে তারা কর্মক্ষম নন। ৮-৯ বছর আগে অবসরে যাওয়ার কারণে তাদের কেউ কেউ নিয়মিত কর্মকর্তাদের চিনতে পারছেন না। কাজের ব্যাপারেও ধারণা নেই। এ কারণেই পদোন্নতি দিয়ে সচিব করার পর দেখা যায় ওই কর্মকর্তা বিগত সরকারের অন্যায্য সুবিধাভোগী। তাই ওএসডি করে পরবর্তী সময় অবসরে পাঠাতে হয়েছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা গতকাল সচিবালয়ে বলাবলি করেছেন, আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্মকর্তাদের শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি পরিস্থিতি বুঝে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত প্রদানের দক্ষতা থাকা জরুরি। যেসব কর্মকর্তা বঞ্চিত ছিলেন ফ্যাসিস্ট আমলে। জ্যেষ্ঠ এসব কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতাকে নানা পন্থায় কাজে লাগানো উচিত তবে প্রশাসনের ভিতকে সমুন্নত রেখে।
অন্যদিকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসনের ২০ ব্যাচের নথি পর্যালোচনা চলছে। ২০০১ সালের ২ মে তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। ওই ব্যাচের ২৯৭ কর্মকর্তার কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। ৪০ জনের অধিক আছেন ওএসডি হয়ে। এ ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তাকে দ্রæত অতিরিক্ত সচিব করা হতে পারে। যদিও তাদের পদোন্নতির ফাইল আগেই প্রস্তুত করা ছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সিনিয়র সচিব দায়িত্ব গ্রহণের পর আরেক দফা যাচাই-বাছাই চলছে। বিগত তিনটি নির্বাচনে কাদের কী ভ‚মিকা ছিল, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্রমতে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও বিতর্কমুক্ত দেখতে চান বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচন সামনে রেখে এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দেওয়া উচিত বর্তমান সরকারকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বিতর্কমুক্ত জনপ্রশাসন গড়তে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
এ নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিঞা বলেন, এ সরকার বরং অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে প্রশাসন চালাতে। পদোন্নতি-বদলিসহ প্রশাসন পরিচালনায় বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। দুর্বল একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় চলছে সময়টা।
সূত্র জানায়, এবার চুক্তিতে সচিব পদে নিয়োগ চাইছেন ভ‚তাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্তরা। এ রকম ১৪ জন কর্মকর্তা সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। তারা প্রত্যেকেই বৈষম্যের শিকার ও বঞ্চিত ছিলেন গেল সরকারের আমলে। এর মধ্যে রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন নবম ব্যাচের মো. শামসুল আলম। রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। আরও আছেন ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ, মো. হাফিজুর রহমান, মহ. মনিরুজ্জামান, মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফসহ ১৩ জন। তারা ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম ও ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। বঞ্চনার শিকার এসব কর্মকর্তার মেধা কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করছেন কেউ কেউ।







