ডুবে যাওয়া নলকূপ ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুন ২০২৪, ৪:০০:০২ অপরাহ্ন
দায় নিতে রাজী নয় কোন বিভাগ!
ছবিঃ সংগৃহীত
এমজেএইচ জামিল : সাম্প্রতিক বন্যায় তলিয়ে যায় সিলেট নগরী ও জেলার ৭টি উপজেলার অধিকাংশ নলকূপ ও মোটর। পানি নামার পর তলিয়ে যাওয়া নলকূপ ও পানির মোটর জীবানুমুক্ত করে ব্যবহারের কথা থাকলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঘটছে এর উল্টো। সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে বিশুদ্ধ পানির পরিবর্তে অপরিস্কার পানি ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বিশুদ্ধ পানির মতো এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যার দায় নিতে রাজী নয় কোন বিভাগ। ডুবে যাওয়া নলকূপ জীবানুমুক্ত করণ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিভিল সার্জন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে সবাই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপরের দায় চাপিয়ে সরে থাকতে চান। এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্ব নিলেও নগর এলাকার দায়িত্ব তাদের নয় বলে জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েছেন সিলেটের কয়েক লক্ষ মানুষ। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে ময়লাযুক্ত পানি ব্যবহার করছেন।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এখনো কার্যকর কোন উদ্যোগ না নেয়ায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। জনসচেতনতার পাশাপাশি নলকূপ জীবানুমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন সচেতন নাগরিকবৃন্দ।
জানা গেছে, সিলেট জেলায় সরকারীভাবে প্রায় ৫০ হাজার নলকূপ রয়েছে। কিন্তু জেলায় বেসরকারী টিউবওয়েল রয়েছে এর কয়েক গুণ। ব্যক্তিগত পর্যায়ের টিউবওয়েলের প্রকৃত তথ্য নেই কারো কাছে। তাই নির্দিষ্ট করে ব্যক্তিগত টিউবওয়েলের সংখ্যাটা বলতে পারছেন না কেউ। তবে সাম্প্রতিক বন্যায় সিলেট নগরীর অন্তত ১৫টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা ও জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকার অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সরকারী ও বেসরকারী দুই প্রকারের নলকূপের খুব একটা বেশী পানির উপর থাকার কথা নয়।
এদিকে সম্প্রতি বন্যায় জেলায় ৫০ হাজারের মতো নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও বাস্তবে আরো বেশী তলিয়ে যাওয়ার কথা। বিভিন্ন উপজেলা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। অনেক জায়গায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত। কিন্তু পানি নামার পর ডুবে যাওয়া নলকূপ জীবানুমুক্ত না করে অনেকেই সেই পানি ব্যবহার করে নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই।
জানা গেছে, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও ভারী বর্ষণে নগরীর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা বন্যা কবলিত হওয়ায় পানি নামার পরও জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। এসব অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ভারী বর্ষণে নগরীর বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় অনেকের মোটর ও টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোর নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী মানুষের মাঝে স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলেও তা চাহিদার তুলনায় ছিল অপ্রতুল। বর্তমানে কিছু স্থানে ত্রাণ সামগ্রী খাদ্য সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত থাকলেও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না বন্যাদুর্গতরা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে অপরিস্কার পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলায় ৫০ হাজারের মতো সরকারী নলকূপ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও কয়েক লক্ষাধিক নলকূপ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলায় সরকারী হিসেবের ৮০ ভাগ নলকূপ পানিতে তলিয়ে যায়। এখনো পুরোপুরি তথ্য কর্তৃপক্ষের হাতে আসেনি। কিছু জায়গায় এখনো পানি রয়েছে। তবে প্রাথমিক হিসেবে অনুযায়ী সিলেট জেলায় প্রায় ২০ হাজারের মতো নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা লাখের উপরে হবে। ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি জীবানুমুক্ত করতে এখনো বিশেষ কোন কার্যক্রম শুরু হয়নি। উপজেলা প্রকৌশলীদের এব্যাপারে বিভিন্ন উপজেলায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিভাবে ডুবে যাওয়া নলকূপ জীবানুমুক্ত করতে হয় সে বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নেতৃবৃন্দকে অবহিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘন্টায় সিলেট বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৬ জন। এরমধ্যে সিলেট জেলার ৪৬ জন, সুনামগঞ্জের ৬ জন, হবিগঞ্জের ৪৮ জন ও মৌলভীবাজারের ৩৮ জন রয়েছেন।
এদিকে গত এক সপ্তাহে সিলেট বিভাগে শুধু ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯২ জন। এরমধ্যে সিলেটের ৩৪৮ জন, সুনামগঞ্জের ১০৪ জন, হবিগঞ্জের ৩৪৬ জন ও মৌলভীবাজারের ২৯৪ জন রয়েছেন।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সিলেট জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল কাশেম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নগরের টিউবওয়েল কিংবা মোটরচালিত নলকুপের সংখ্যা আমাদের কাছে নেই। তবে জেলার তথ্য আছে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে প্রকৌশলীদের ডুবে যাওয়া নলকূপের সংখ্যা নিরূপণ ও জীবানমুক্তকরণের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বন্যাকবলিত উপজেলা সমূহে আমাদের পক্ষ থেকে ৭ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। পানি পুরোপুরি কমে গেলে স্বাস্থ্যসচেতনামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হবে। উপজেলা পর্যায়ে কেউ যদি ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি জীবানুমক্ত করতে চান তাহলে আমাদের উপজেলা প্রকৌশলীদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সিলেটের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের অভিমত, বন্যা পরবর্তী সময়ে দূষিত পানি পানের কারণে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তলিয়ে যাওয়া নলকূপ জেগে ওঠার পরপরই জীবাণুমুক্ত করে নেয়া উচিত। এটি করতে হলে প্রথমে ১২-১৫ লিটার পানি একটি বালতিতে নিয়ে ২০০-৩০০ গ্রাম পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার ভালোভাবে মেশাতে হবে। এরপর একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মিশ্রণ ছেঁকে নিতে হবে অথবা মিশ্রণ স্থির হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পরে নলকূপের পাম্পের হাতল ও প্লাঞ্জার রড পাম্প থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে। এরপর মিশ্রণের অর্ধেক পানি পাম্পের ভেতর ঢালতে হবে। পরে হাতল ও প্লাঞ্জার রড ভালোভাবে পরিষ্কার করে ময়লা বা কাদা সরাতে হবে। অতঃপর হাতল ও প্লাঞ্জার রড পুনরায় স্থাপন করে ঘোলা পানি দূর না হওয়া পর্যন্ত পাম্প করতে হবে। পাম্পের সাহায্যে পর্যাপ্ত পানি পাওয়ার পরপরই অবশিষ্ট মিশ্রণ পাম্পের ভেতর ঢালতে হবে এবং ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরিনের গন্ধ থাকা পর্যন্ত পাম্প করতে হবে। সবশেষে নলকূপের আশপাশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
মোটরচালিত নলকূপও একই নিয়মে বিশুদ্ধকরণ করতে হবে। অন্যথায় অনিরাপদ পানি ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে থাকবে। যারা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করে নিয়েছেন ভালো। যারা এখনো নলকূল জীবানুমুক্ত করেননি তাদেরকেও দ্রুত বিশুদ্ধকরণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ডুবে যাওয়া নলকুৃপ কিংবা মোটরচালিত নলকুপের পানি জীবানুমুক্ত না করে ব্যবহার করা কোনভাবেই ঠিক নয়। নগরীর ডুবে যাওয়া নলকুপ জীবানুমুক্ত করার দায়িত্ব প্রকৌশল বিভাগের। তবে আমাদের স্বাস্থৗ বিভাগের পক্ষ থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সিলেটের ডেপুটী সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় শংকর দত্ত দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে নলকুপের পানির সমস্যা সমাধানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কাজ করছে। আর নগরে কাজ করছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। আমাদের পক্ষ থেকে পানি বন্যার্তদের মাঝে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া আমাদের একাধিক মেডিকেল টিম মাঠ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বন্যা-পরবর্তী দূষিত পানি পানের কারণে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তলিয়ে যাওয়া নলকূপ জেগে ওঠার পরপরই জীবাণুমুক্ত করে নেয়া উচিত।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী আলী আকবর দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সাপ্লাই পানির বিষয়টি দেখভাল করে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিউবওয়েল কিংবা মোটরের ব্যাপারে কোন সমস্যা হলে নিজ উদ্যোগেই সমাধান করতে হয়। নলকুপ জীবানুমুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও কিংবা মিস্ত্রিরা ভালো বলতে পারে।
সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হারুন-অর-রশিদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নলকুপের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধিন নয়। এব্যাপারে করনীয় নির্ধারণ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ।