সর্বজনীন পেনশন স্কীম নিয়ে তুলকালাম
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জুন ২০২৪, ১২:৩০:০৫ অপরাহ্ন
সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কীম বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন দেশের সব পাবলিক অর্থাৎ সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাদের ঘোষণা ৩০ জুনের মধ্যে দাবি আদায় না হলে ১ জুলাই থেকে একযোগে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাবেন তারা। এর পাশাপাশি এসব বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা ৩০ জুন থেকে এবং কর্মচারীরা ১ জুলাই থেকে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। এর ফলে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর আগে গত ১৩ মার্চ একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয় যে, সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রয়াত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকুরিতে যেসব কর্মকর্তারা বা কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাই ও তার পরে নতুন যোগদান করবেন, তাদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের অন্তর্ভুক্ত করবে সরকার। নতুন এ স্কীমের নাম দেয়া হয় ‘প্রত্যয়’।
কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি মানছেন না বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সরকারি এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষক সংগঠনগুলো। আগের পেনশন স্কীম চালু রাখা ও পেশাগত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তনের দাবিও জানিয়ে আসছেন তারা। প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশনে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের অনিহা কেনো? শিক্ষক নেতারা বলছেন, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের এই সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষকরা বিদ্যমান আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘পেনশন’ শব্দটি আর্থিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। যে পেনশন স্কীমের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা প্রতারণার শামিল। অপেক্ষাকৃত কম আর্থিক সুবিধা কেউই চাইবে না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে একটি চক্র কাজ করছে। তারা চাচ্ছেন না যে কোন মেধাবী ছাত্র এখানে থাকুক। বিষয়টি চরম ষড়যন্ত্রমূলক।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোঃ আখতারুল ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, পূর্বের পেনশন ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক অবসরের পর এককালীন ৮০/৮১ লাখ টাকা পেতেন। এই স্কীমে সেটা নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আমাদের এই পেনশন স্কীমে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। যদিও বলা হচ্ছে আগামী বছর তাদের জন্যও সর্বজনীন পেনশনের স্কীম চালু করা হবে। সেখানে তাদের কেমন সুযোগ সুবিধা থাকবে সেটা তো আমরা জানি না। আমরা একই ব্যবস্থার আওতায় ছিলাম। হঠাৎ করে আমাদেরকে বের করে দেয়া হলো এবং উনারা নাকি পরের বছর যোগ দেবেন। সুতরাং সব জায়গায় আমরা শুভঙ্করের ফাঁকি দেখতে পাচ্ছি। এ কারণেই আমরা এটি প্রত্যাখ্যান করলাম।
সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের মতে, শিক্ষাখাত কতোটা ভিন্নভাবে দেখা হয়, তার বড়ো প্রমান, ক্যাডার সার্ভিস। সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরে রেখে প্রথমেই পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বজনীন বেতন স্কেলের আওতায় আনার মধ্য দিয়ে। আসলে এদেশে পদে পদে শিক্ষাখাতকে বৈষম্যমূলকভাবে হেয় করা হয়।
গত ২৭ জুন একটি জাতীয় মিডিয়ায় ‘বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এ- ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ ইমরান খানের লেখা এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত ১৩ জুন সংশ্লিষ্ট কারো সাথে আলোচনা বা পর্যালোচনা না করেই সর্বজনীন ‘প্রত্যয়’ নামক পেনশন স্কীম চালু করা হলো। বলা হলো ‘সর্বজনীন’। কিন্তু আপনারা নিলেন না। তাহলে এটা সর্বজনীন হলো কিভাবে? লেখক আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, খুবই সুচারুভাবে একটি কুচক্রী মহল ধীরে ধীরে এদেশের শিক্ষার কোয়ালিটি হ্রাস করছে। এর ১ম ধাপে তারা ২০১৫ সালে পে-স্কেলে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তো দেয় নাই, বরং গ্রেড আরো অবনমন করে নিজেরা সুপার গ্রেড তৈরি করে নিয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে প্রথম যোগদানের সময়ের যে ৩/৪টি ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যেতো, তা বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিএইচডি অর্জনের জন্য যে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হতো তা নিয়ে টালবাহানা চলছে। এদেশের বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশ^বিদ্যায়ের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে কম। তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে এই শিক্ষকতা পেশায় কোনো মেধাবী গ্র্যাজুয়েট কেনো আসবে? তারপরও দেশপ্রেমের আবেগ ও তাগিদ এবং ভালো পেনশনের আশায় এখনো অনেক মেধাবী এই পেশায় আসেন। কিন্তু এই পেনশন স্কীম ‘প্রত্যয়’ চালু হলে আর কোন প্রথম সারির মেধাবী গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকতা পেশায় আসবে না। এভাবে জাতি মেধাশূন্য হবে। তিনি একটি পরিসংখ্যান দিয়ে লিখেছেন, সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৪৯ হাজার ১৫১ জন।
লক্ষণীয় যে, সর্বজনীন পেনশন স্কীম নিয়ে শুরু থেকেই নানা আলোচনা সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে মিডিয়ায়। এমনকি অনেকে এটাকে জনগণের অর্থ আত্মসাতের নতুন চক্রান্ত বলেও আখ্যায়িত করছেন। তাই পূর্ণাঙ্গরূপে এটা চালুর আগে এ বিষয়ে আরো যাচাই ও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ ও সচেতন মহল।